ঢাকা, সোমবার   ০৭ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বিস্মৃতির অন্ধকারে কৌতুক সম্রাট খান জয়নুল

বোরহান মাহমুদ

প্রকাশিত : ১৬:১৫, ১৫ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৭:১৬, ১৫ এপ্রিল ২০২০

Ekushey Television Ltd.

খান জয়নুল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কৌতুক সম্রাট তিনি। ঢাকাই চলচ্চিত্রে যে ক’জন কৌতুক অভিনেতা স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন তাদের অন্যতম অগ্রজ ছিলেন তিনি। দর্শকদের হৃদয়ে ওপার বাংলায় ভানু বন্দোপাধ্যায় যেমন কৌতুক অভিনয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, বাংলাদেশে তেমনি জয়নুল। অথচ এমন সাফল্যধারায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্রকে যিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন, তাকে এখন কেউ মনে রাখে নি। তাকে নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদন-

খান জয়নুলের অভিনয় করারর শখ ছির ছোটবেলা থেকেই। ১৭ বছর বয়সে যখন গোপালগঞ্জের এক স্কুলে পড়তেন তখন তিনি নাটকে প্রথম অভিনয় শুরু করেন। ক্রমেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ হয়ে উঠেন এবং তিনি কলকাতায় চলে যান সিনেমাতে অভিনয় করার উদ্দেশ্যে। খান জয়নুল- নাম পরিবর্তন করে ‘মৃণাল কান্তি রায়’ নামে কোলকাতার কিছু সিনেমাতে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেন। দেশ ভাগ হলে চলে আসে ঢাকায়। এখানে এসে মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করার পাশাপাশি নাটক লেখালেখিও করেছেন। এরপর এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশীয় কলাকুশলীদের নিয়ে সিনেমা তৈরির প্রথম সুযোগ সৃষ্টি হলে তাতে যুক্ত হন।

ঢাকার চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম আবির্ভাব ঘটে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ সিনেমার মাধ্যমে। তুমূল জনপ্রিয় খান জয়নুল অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে- দুই দিগন্ত, ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন, সখিনা, সাইফুল মুল্‌ক বদিউজ্জামান, কাঁচ কাটা হীরে, সন্তান, পদ্মা নদীর মাঝি, দর্পচূর্ণ, মধুমালা, সপ্তডিংগা, ময়নামতি, যে আগুনে পূড়ি, মিশরকুমারী, অন্তরংগ, নীল আকাশের নীচে, মায়ার সংসার, রং বদলায়, মধু মিলন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, নায়িকা, আদর্শ ছাপাখানা, মাটির মায়া, অশান্ত ঢেউ, দিনের পর দিন, স্মৃতি তুমি বেদনা, নাচের পুতুল, পীচ ঢালা পথ, ত্রিরত্ন, ইয়ে করে বিয়ে, ঝড়ের পাখি, মানুষের মন, দাসী, প্রতিশোধ, অবুঝ মন, ছন্দ হারিয়ে গেলো, পায়ে চলার পথ, কে তুমি, সতী নারী, জীবন তৃষ্ণা, মাসুদ রানা, চোখের জলে, আঁধারে আলো, বাদী থেকে বেগম, দূর থেকে কাছে, ভুল যখন ভাঙ্গলো, আলোর মিছিল, পরিচয়, দুই পর্ব, জীবন সাথী, সন্ধিক্ষণ, ডাক পিওন, সাধু শয়তান, আদালত, গোপাল ভাঁড়, দিওয়ানা অন্যতম।

বেশীরভাগ সিনেমাতে কৌতুকাভিনয় করলেও, কোনো কোনো সিনেমাতে তিনি সহনায়ক ও আবেকঘন-গুরত্বপুর্ণ চরিত্রেও অভিনয় করেছেন কৃতিত্বের সাথে।

খ্যাতিমান পরিচালক আজিজুর রহমানের মতে, ছোটখাট গড়নের হওয়া খান জয়নুল নিজের অভিনয়ের মুন্সিয়ানা দেখাতে পেরেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। সেই সঙ্গে বিশ্বস্ত চোখের উপর ভ্রু’র নাচন খান জয়নুলকে দিয়েছে বিশেষত্ব। তিনি কৌতুককে শিল্প পর্যায় উন্নীত করে এর স্বাতন্ত্র দান করেন। যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

প্রয়াত কৌতুক শিল্পী টেলি সামাদ এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘খান জয়নুল মুখের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে যে অভিনয় করে গেছেন তা রীতিমত বিস্ময় জাগায়। তিনি একজন জাত অভিনেতা ছিলেন। কৌতুককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অথচ আমরা তাকে মুল্যায়ন করিনি।’

খান জয়নুলকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় টেলি সামাদ আরও বলেছিলেন, ‘বিয়ে ও বউ নিয়ে খান জয়নুল ভাইয়ের জীবনে একটা দুঃখবোধ ছিল। বাসর ঘরে যখন দেখলেন স্ত্রী খুব কাঁদছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সব জেনে স্ত্রীর পছন্দের প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে দিলেন। এটা ছিল বিরাট এক ত্যাগ। অভিনয় জীবনেও তিনি সহকর্মীদের মাঝে এই ত্যাগের উদাহারণ রেখেছেন। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি পানাসক্ত হয়ে পড়েন। কেবল দুঃখবোধটা ভোলার জন্য নিজেকে দুনিয়ার লোকচক্ষু থেকে দুরে সরে থাকতেন। কখনো কখনো প্রযোজক-পরিচালকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে অপেক্ষা করেছে কখন তার নেশা কাটে। এমন জাত অভিনেতা সত্যি বিরল। অথচ তাকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি মুল্যায়ন করতে পারেনি। তিনি কখনই বৈষয়িক ছিলেন না। কামিয়েছেন দু’হাতে তেমনি খরচও করেছেন। কেবল অভিনেতা নয় একজন বড় হৃদয়ের মানুষ তিনি।’

চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, ‘খান জয়নুলকে বাদ দিয়ে এদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাস পূর্ণাঙ্গতা পাবে না। তার মতো কমেডিয়ান যুগে যুগে আসবে না। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ তার ব্যাপারে ইতিবাচক মানসিকতা ধারণ করা।’

পুরস্কারখ্যাত পরিচালক সিবি জামান খান জয়নুলকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘খুব পান করতেন। মনে পড়ে ‘ঝড়ের পাখি’র শুটিং করছি। সে আসছে না। পরে তার ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে দেখি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মদে চূর। ওই অবস্থাতেই তাকে তুলে এনে সেটে হাজির করলাম। তিনি শুধু বললেন সব রেডি করেন টেক করার সময় আমাকে একটু ধাক্কা দিবেন। হলোও তাই। তার আরেকটি ক্ষমতা ছিল ইম্প্রোভাইস করার। তিনি শট নেওয়ার সময় বলতেন একভাবে ডাবিং করার সময় সেটা বদলে দিতেন কিন্তু দর্শক কিছুই বুঝতো না। স্ক্রিপ্ট একবার দেখলেই বাকিটুকু বলে দিতেন কি আছে। অসাধারণ তার ক্ষমতা। মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশে এলেন তখন খান আতার সভাপতিত্বে হোটেল ইন্টারকনে একটা রিসিপশনের আয়োজন করলাম। সেখানে আমাদের শিল্পীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু খান জয়নুল। খান জয়নুলের কৌতুক ক্ষমতা দেখে ভানু দা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন এই না হলে ঢাকাইয়া, তুমিই পারবে।’

আসলে কতটুকু তিনি পেরেছিলেন জানি না তবে তার মতো করে আর কেউ পারবে বলে মনে হয় না"- যোগ করেন সিবি জামান।

৪২ বছরের জীবনে খান জয়নুল অর্ধশত সিনেমাতে অভিনয় করেন। নাট্যকার হিসেবেও খান জয়নুল যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা হাসির নাটক ‘শান্তিনিকেতন’ মঞ্চস্থ হলে তখনকার সময়ে দর্শকদের অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। ‘ঘর মন জানালা’ তাঁর রচিত একটি জনপ্রিয় নাটক ছিল।

টেলিভিশনের অত্যান্ত জনপ্রিয় ‘ত্রিরত্ন’ সিরিজে খান জয়নুল চুনি চরিত্রে অবিস্মরণীয় অভিনয় করে দর্শকদের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। 

খান জয়নুল বিক্রমপুর জেলার লৌহজং এর রানাদিয়ায় ১৯৩৬ সালের ৪ জুলাই জন্মগ্রহন করেন। একাধারে অভিনেতা, নাট্যকার ও কাহিনীকার এ মহান শিল্পী ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক : চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাতা

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি