খল ও কৌতুক কিংবদন্তী এটিএম শামসুজ্জামান
প্রকাশিত : ২২:১৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান
কখনও মন্দ মানুষ, কখনও হাস্যরসের ভাণ্ডার নিয়ে রুপালী পর্দায় দেখা যায় এক চিরচেনা মুখ। যখনই যে চরিত্রে তিনি পর্দায় হাজির হয়েছেন দিয়েছেন ভিন্ন স্বাদের বিনোদন। চলচ্চিত্রে গ্রাম্য বদ মাতব্বর, নানা ধরনের দুষ্ট লোক কিংবা গতানুগতিকের চেয়ে অন্য ধারার কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে তিনি পেয়েছেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা।
তিনি এটিএম শামসুজ্জামান। পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। এ যাবৎ ৩০০ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। দেশের চলচ্চিত্র ও নাটকে যে কয়জন শক্তিমান অভিনেতা, তাদের অন্যতম এটিএম শামসুজ্জামান কেবল একটি নামই নয়, একটি দুর্দান্ত ইতিহাস। তিনি একাধারে একজন অভিনেতা, পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার। শুরুতে মঞ্চে কাজ করতেন অভিনেতা হিসেবেই। চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। এরপর আসেন খল অভিনয়ে। অসংখ্য চলচ্চিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের খল চরিত্রগুলো আজও জীবন্ত।
জন্ম
এটিএম শামসুজ্জামান ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নূরুজ্জামানের পৈতৃক নিবাস লক্ষীপুরের ভোলাকোটের বড় বাড়িতে। তৎকালে শামসুজ্জামানের বাবা নামকরা আইনজীবী ছিলেন। রাজনীতিতেও ছিলেন পারদর্শী। নূরুজ্জামান শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। শামসুজ্জামানের মায়ের নাম নুরুন্নেসা বেগম। নূরজ্জামান-নুরুন্নেসা দম্পতির আট ছেলে মেয়ের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
লেখাপড়া
এটিম শামসুজ্জামান বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। পগোজ স্কুলে পড়ার সময় তার সহপাঠী ছিলেন আরেক শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। এক পর্যায়ে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন শামসুজ্জামান। তারপর তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।
চলচ্চিত্রে আগমণ
১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন এটিএম শামসুজ্জামান। ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি লেখেন কাহিনী ও চিত্রনাট্য। এটিই ছিল তার প্রথম কাহিনী ও চিত্রনাট্য। ছবির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। তার কাহিনী ও চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে অভিনেতা ফারুকের। তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লেখার অর্জন রয়েছে।
অভিনেতা হিসেবে যাত্রা
১৯৬৫ সালের দিকে অভিনেতা হিসেবে বড় পর্দায় আগমণ। প্রথমে একজন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন এটিএম শামসুজ্জামান। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন তিনি।
‘দায়ী কে?’ চলচ্চিত্র ছাড়াও কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ চলচ্চিত্রে তাকে কৌতুক চরিত্রে দেখা যায়।
শুরুতে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করলেও আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রটিই তাকে খল অভিনেতার তকমা এনে দেয়। তিনি ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘স্বপ্নের নায়ক’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মণিকোঠায় স্থান করে নেন।
খল চরিত্র ছাড়াও পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘চোরাবালি’ উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্র।
মূলত পরিচালনার মাধ্যমেই এটিএম শামসুজ্জামানের চলচ্চিত্রে যাত্রা হয়। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটির ‘এবাদত’ নামের ছবিটি।
সম্মাননা
১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দায়ী কে?’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এটিএম শামসুজ্জামান। ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ চলচ্চিত্রে কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। এটিএম শামসুজ্জামান রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’তে অভিনয় করেন এবং শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তাকে ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১৭) অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
শিল্পকলায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একই সালে তিনি ঢাকা মডেল এজেন্সি এ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা ভূষিত হন। এছাড়া অভিনেতা বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা পদকও অর্জন করেন এটিএম শামসুজ্জামান।
উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ
অভিনয় জীবনের শুরুতে ষাটের দশকে টিভি নাটকে অংশগ্রহণ ছিল তার। তার উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকসমূহ হলো- রঙের মানুষ, ভবের হাট, ঘর কুটুম, বউ চুরি, নোয়াশাল, শতবর্ষে দাদাজান।
উল্লেখযোগ্য সিনেমা
তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হচ্ছে- মলুয়া, বড় বউ, অবুঝ মন, ওরা ১১ জন, শ্লোগান, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, সংগ্রাম, ভুল যখন ভাঙ্গলো, চোখের জলে, লাঠিয়াল, অভাগী, নয়নমনি, যাদুর বাঁশি, গোলাপী এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, সূর্য দীঘল বাড়ী, ছুটির ঘণ্টা, লাল কাজল, পুরস্কার, প্রিন্সেস টিনা খান, রামের সুমতি, ঢাকা ৮৬, দায়ী কে?, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, দোলনা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক, তোমার জন্য পাগল, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ, জামাই শ্বশুর, আধিয়ার, শাস্তি, মোল্লা বাড়ির বউ, হাজার বছর ধরে, আমার স্বপ্ন তুমি, দাদীমা, আয়না, ডাক্তার বাড়ী, চাঁদের মতো বউ, মন বসেনা পড়ার টেবিলে, এবাদাত, বিশ্বাসসহ অসংখ্য ছবি।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে খানিক ব্যর্থতার ছাপ এনে দিয়েছে তার দুই পুত্র। ২০১২ সালে তার বড় সন্তান এটিএম কামালুজ্জামান কবিরকে নিজ বাসায় হত্যা করে ছোট ছেলে এটিএম খলিকুজ্জামান কুশল। এরপর পিতা হয়েও ছোট ছেলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন এই অভিনেতা। সাক্ষ্য দেন আদালতে গিয়ে। ভাইকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন সাজা হয় ছোট ছেলে কুশলের। তবে অভিনেতার অন্য এক ছেলে এবং তিন মেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বাবাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়।
মৃত্যু
বরেণ্য কিংবদন্তী এই অভিনেতা ২০ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) সকালে রাজধানীর সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর।
এনএস/