ওয়েব সিরিজ ও এর শিল্পবিচার
প্রকাশিত : ১৪:২১, ৬ জুলাই ২০২০
ওয়েব সিরিজ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জনপ্রিয় এবং একইসাথে বহুল সমালোচিত। ডিজিটাল যুগে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ওভার দা টপ (ওটিটি) প্লাটফর্ম।
প্রচলিত টেলিভিশন প্রথার বাইরে এর ক্ষেত্র। তবে টেলিভিশনগুলোও এই এই প্লাটফর্মে প্রবেশ করার সুযোগ আছে। হচ্ছেও তাই। তবে এই প্লাটফর্মে বিশেষ করে সিরিজ (ধারবাহিক) গুলোর চরিত্র সাধারণ ধারাবাহিক নাটক বা চলচ্চিত্র থেকে কিছুটা ভিন্ন এমন দাবি নির্মাতাদের। বিশেষ করে কনটেন্ট কিছুটা ভিন্ন।
নির্মাতারা একে আঠারো বছরের বেশি বয়স যাদের তারা এর দর্শক বলে দাবি করছেন। আবার ওটিটি প্লাটফর্ম ইউটিউবের মতো উন্মুক্ত কোন পরিমন্ডল নয়। এতে প্রবেশ করতে হলে একাউন্ট খুলতে হবে, পয়সা দিয়ে সদস্য পদ নিতে হবে। তারপর পছন্দের বিষয় দেখার সুযোগ পাবে। তবে বাংলাদেশে এর প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন।
ওটিটি প্লাটফর্মের কয়েকটি সিরিজের টুকরো অংশ চলে এসেছে ইউটিউবে। ফলে অনেকের দৃষ্টিগোছর হয়েছে সেগুলো। বলা হচ্ছে যা ইউটিউবে এসেছে তা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেখার মতো নয়।
বিপরীতে নির্মাতারা দাবি করছেন, তাদের নির্মাণ পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার জন্য নয়। আবার এসব ইউটিউবে এলো কি করে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। যদিও এ বিষয়ে নির্মাতারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। আবার বলা হচ্ছে কোন প্লাটফর্ম সেটি বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে বাংলাদেশে সিরিজ, চলচ্চিত্র, নাটক যাই নির্মাণ হোক তাতে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রকাশ থাকতে হবে। এর ভিতরে ভিন্ন সংস্কৃতি চালান করে দিলে তা আর মৌলিক থাকে না।
এ প্রসঙ্গে আমরা একটু ওয়েব সিরিজের ইতিহাস ঘেটে আসি চলুন। কোথা থেকে এলো, কিভাবে এর বিস্তার একটু জেনে নিলে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে সহজ হবে।
ওয়েব সিরিজের ইতিহাস:
নব্বই দশকের মাঝামাঝি ‘দি স্পট‘ এর মাধ্যমে ওয়েব সিরিজ এর ধারণা সম্মুখে নিয়ে আসেন নিইউয়র্কের নির্মাতা স্কট জাকারিন। মূলত এটা ছিল ওয়েব নির্ভর একটি গল্পের সিরিজ। নির্মাণ করা হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিচ হাউসে। ১৯৯৫ থেকে ৯৭ দুই বছর সফলতার সাথে এ সিরিজ চলে। এর কাহিনী বিস্তার হয় একদল তরুণ-তরুণীর প্রতি দিনের জীবনযাপনের দৃশ্য দর্শকের সম্মুখে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। যাতে তাদের যৌন জীবনের প্রকাশও ছিলো।
এ সিরিজটি ওয়েবি এওয়ার্ড‘ অর্জন করেছিলো। তবে স্কট যেভাবে ওয়েব সিরিজকে সামনে নিয়ে এসেছিল তারও বদল হয়েছে। সেখানে মিডিয়া জায়ান্টদের যুক্ত হওয়ার বিষয়সহ বহু ঘটনা প্রবাহ রয়েছে। যার ফলে এক সময় সেখান থেকে ছিটকে পড়েছিলেন স্কট জাকারিন।
শূন্য দশকের শুরু থেকেই বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে ওয়েব সিরিজ আরো জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ২০১৩ সালে এসে একমাত্র ওটিটি প্লাটফর্ম ‘নেটফ্লিক্স‘ তার সিরিজের জন্য ‘৬৫ তম প্রাইসটাইম এমি এওয়ার্ড‘ অর্জন করে। সে সময় তিনটি সিরিজ, হাউস অব কার্ডস, এরেস্টেড ডেভেলপমেন্ট এবং হেমলক গ্রোভ এই সম্মাননার জন্য মনোনয়ন পায়। এটিই বিশ্বে ওয়েব সিরিজের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
বিউ উইরিয়ামসনের হাউস অব কার্ডস, একটি আমেরিকান পলিটিক্যাল থ্রিলার। এতে নির্মম রাজনৈতিক বাস্তবতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী রয়েছে। এ সিরিজটি অসংখ্য পুরষ্কার অর্জন করেছে।
বাকি দু’টির এরেস্টেড ডেভেলপমেন্টকে ওয়েব সিরিজ বলা যাবে না, কারণ সেটি প্রচারিত হয়েছিল ফক্স টিভিতে। তবে হেমলক গ্রোভ ওয়েব সিরিজ। সেটি প্রচারিত হয়েছিল নেটফ্লিক্সে। এ তিনটি নির্মিত হয়েছিল আমেরিকায়। হেমলক গ্রোভের কাহিনী একটি দরিদ্র অঞ্চল কেন্দ্র করে, যেখানে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে চাকরি হারায় আর সে এলাকায় দুই তরুণী খুন হওয়ার ঘটনায় এর বিস্তার।
ওয়েব সিরিজের সাম্প্রতিক বাজার
বরাবরের মতো ইংরেজি ভাষার ওয়েব সিরিজগুলোই পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়। বলা হচ্ছে ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগেই এগুলো সবার দেখা উচিত। কয়েকটির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-ফ্রেন্ডস, ব্রেকিং বেড, গেম অব থ্রনস, দি ওয়াকিং ডেড, সিনফেল্ড, শার্লক, দি বিগ বেঙ থিউরি, দি সোপ্রানোস, এ্যারো এবং ডেক্সটার।
এছাড়াও আরও বেশকিছু সিরিজ রয়েছে ইংরেজি ভাষার। যেগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। ইংরেজি ভাষার পর সম্ভবত স্পেনিস ভাষার ওয়েব সিরিজ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। যেমন মানি হাইস্ট (লা কাসা দে পাপেল)। গল্প- সালভাদর ঢালির মুখোশ পড়ে আটজন চোর দখলে নেয় রয়েল মিন্ট অব স্পেন। সেখান থেকে পুলিশের মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ঘটনাই এর মূল উপজিব্য।
তারপর আছে ‘এলিট‘একটি প্রাইভেট স্কুলে তাও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে বিরোধ। এটাই ছবির মূল গল্প। বলা যেতে পারে ‘ক্যাবল গার্ল (লাস সিকাস ডেল কার্লি)র কথা। ১৯২০ সালের একটি টেলিফোন কোম্পানিতে তিন রমণীর রোমান্স, আধুনিক কর্ম পরিবেশ তৈরি এবং বন্ধুত্ব তৈরিকে ঘিরে কাহিনী এগিয়ে যায়। সেখানেও খুনের ঘটনা পুরো ছবিকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। আছে প্রেম এবং রোমান্স।
এছাড়া স্পেনিস ভাষার আরো বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজের কথা বলা যায় যেগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেমন Velvet, Paquita Salas, The Ministry of Time (এল মিনিস্টরারিও ডিল টিয়ামপো), Grand Hotel (Gran Hotel), The Time In Between (এল টিয়াম্পু এনত্রা কস্তোরাস), Plastic Sea(Mar de plástico), Morocco: Love In Times of War (Tiempos de গেররা), Merlí।
আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে নজর দেয়া যাক। সেখানে কি অবস্থা। পুরো ভারতে এখন ওয়েব সিরিজের বিশাল বাজার। তাদের রয়েছে অসংখ্য ওটিটি প্লাটফর্ম।
ARRE,EROS NOW, HYFLIX, MUBI, SONY LIV, TVF Play, VIU, Vodafone Play, VOOT, Adda Times, Airtel Xstream, ALT Balaji, Big Flix, HOI CHOI আরো অসংখ্য ওটিটি প্লাটফর্ম রয়েছে ভারতে।
পশ্চিমবঙ্গে এসব প্লাটফর্ম সমান জনপ্রিয়। আমাদের বাংলাদেশে ক‘টি আছে। এক বঙ্গ, বিন্জসহ সম্ভবত আরও দু‘একটি থাকতে পারে। বাকি যেগুলো রয়েছে সেগুলো ভারতের। বাণিজ্য করছে বাংলাদেশে।
ভারতেও দেখেছি ওয়েব সিরিজ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সম্প্রতি ‘রসভেরি‘ নামে পশ্চিম বঙ্গের একটি সিরিজ নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে উঠেছে। এছাড়া হইচই এ যেসব ওয়েব সিরিজ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো রয়েছে সমালোচনায় তুঙ্গে।
পশ্চিমা বিশ্বের কিছু পরিসংখ্যান
কমস্কোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৫০ মিলিয়ন ওটিটি প্লাটফর্মে দর্শকদের মধ্যে জরিপ চালিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পয়সা দিয়ে দেখতে চান এমন দর্শকের পরিমাণ ৬৯ শতাংশ। আবার কি দেখতে চান তারা? ৩০ শতাংশ বলেছেন তারা খেলা দেখতে চান, ৩৫ শতাংশ বলেছেন অরিজিনিাল কনটেন্ট দেখতে চান, মানে নিজস্ব তৈরি। আর ১৯ শতাংশ দেখতে চান মুভি এবং ১৮ শতাংশ টিভি-শো।
তবে ক্রমান্বয়ে দেখলে বোঝা যায় ওটিটি প্লাটফর্মের দর্শক বাড়ছে। ইউরোপে ২০১৪ সালে দর্শক ছিল ১১.২ মিলিয়ন, ২০১৫ তে ১৪.৩ মিলিয়ন, ২০১৬ তে ১৭.৫ মিলিয়ন, ২০১৭ তে ২০.৯ মিলিয়ন, ২০১৮ তে ২৪ মিলিয়ন, ২০১৯ এ ২৭ মিলিয়ন এবং ২০২০ এ ২৯.৬ মিলিয়ন যা ২০২১ সালে ৩১.৮ মিলিয়নে দাঁড়াবে বলে আশা করেছে তারা।
এককভাবে আমেরিকার কি অবস্থা সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। ২০১৭ তে দর্শক ছিল ১৫৩ মিলিয়ন, ২০১৮ তে ১৭০.১ মিলিয়ন, ২০১৯ এ ১৮১.৫ মিলিয়ন, ২০২০ এ ১৮৮.৩ মিলিয়ন। এছাড়া আগামী দুই বছর ২০২১ এ দর্শক দাঁড়াবে ১৯৩.২ মিলিয়ন এবং ২০২২ সালের দিকে দাঁড়াবে ১৯৭.৭ মিলিয়নে।
আবার ভিন্ন ভিন্নভাবে ওটিটি প্লাটফর্মের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমেরিকাতে শীর্ষে আছে নেটফ্লিক্স। সে দেশে এ প্লাটফর্মের মোট ভিউয়ার ১৫৮.৮ মিলিয়ন, প্রাইম ভিডিও ৯৬.৫ মিলিয়ন, হোলো ৭৫.৮ মিলিয়ন, এইচবিও নাও ২৩.১ মিরিয়ন এবং স্লিং এ রয়েছে ৭ মিলিয়ন দর্শক। পুরো বিশ্বে এখন শীর্ষ বাণিজ্যে আছে প্রায় ৬০ টির মতো ওটিটি প্লাটফর্ম।
এই যে এত হিসেব, এত কথা বললাম, তা শুধু নিজেদের অবস্থান কোথায় সেটি বুঝানোর জন্য। বিশ্বে বিশাল বাজার ওটিটি প্লাটফর্মের। আমরা এই বাজারের কোথায় আছি? বলতে গেলে একবারে তলানিতে। সম্প্রতি বিন্জ নামের একটি ওটিটি প্লাটফর্ম তিনটি ওয়েব সিরিজে অর্থায়ন করেছে।
শিহাব সুমন পরিচালিত ‘অগাস্ট ১৪’, ওয়াহিদ তারেকের ‘বুমেরাং’ এবং সুমন আনোয়ারের ‘সদরঘাটের টাইগার’। এই তিনটি কাজ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ হলো- এসব ছবিতে খোলামেলা কিছু দৃশ্য রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সাথে যায় না।
টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে এসবের কড়া সমালোচনা চলছে। আমি নিজেও ‘ইউকে বাংলা স্টার (ইউবিএস টিভি https://www.youtube.com/channel/UCTRmL5xLxDwJ3NVWcdFLGmA) থেকে সম্প্রতি একটি টক-শো আয়োজন করেছিলাম। আমার সঞ্চালনায় এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিতি ছিলেন নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজা এবং শিল্পবোদ্ধা আলমগীর হক স্বপন। দু‘জনেরই বক্তব্য ছিল ওয়েব সিরিজের পক্ষে। তবে তারাও ওইসব কথিত খোলামেলা দৃশ্য নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।
তারা বিভিন্ন কাজের উদাহরণ টেনেছেন। বলেছেন, নিজের যা আছে তা নিয়েই শিল্পমান সম্পন্ন ওয়েব সিরিজ তৈরি করা সম্ভব। তারা দু‘জন বাংলাদেশের নাটক-চলচ্চিত্র বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়ার যোগ্যতা রাখেন। তাদের পরামর্শ এ বিষয়ক নীতি নির্ধারকরা গ্রহণ করতে পারেন।
যে তিনটি ওয়েব সিরিজের কথা বললাম তাতে আগাস্ট ১৪ এর কথা যদি প্রথমে বলি। তাহলে কাজের মান নিয়ে তেমন প্রশ্ন নাইবা করলাম। কিন্তু পিতা-মাতাকে হত্যা করার পর টুসির পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনায় কিছু দৃশ্য যুক্ত হয়েছে। পরিচালক যদিও ঘটনার প্রয়োজনে সেসব দৃশ্য বললেও তা পরিহার কিংবা অন্যভাবে উপস্থাপন করা যেতো। শুনেছি সেসব দৃশ্যের কিছু নাকি এখন বাদ দিয়ে তা আবার অনলাইনে ছাড়া হয়েছে।
এবার আসি ‘বুমেরাং‘ বিষয়ে। এ ওয়েব সিরিজটিতে যেসব খোলামেলা দৃশ্য আনা হয়েছে তা আরোপিতই মনে হয়েছে। এ ওয়েব সিরিজটি কোন শিল্পমানে পড়ে না। আর সদরঘাটের টাইগারও একই দোষে দুষ্টু। এতে গল্পের তেমন আবেদন নেই। আর অহনা রহমানের মতো একজন পরিচিত অভিনেত্রীর মুখে যে ডায়লগ শোনা যায় তা পুরোপুরি ভব্যতাহীন।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব ওয়েব সিরিজ তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পবোধের কোন স্থান দেখলাম না। আমাদের পশ্চিমা অনুকরণের একটা প্রবণতা রয়েছে। এসব সিরিজে তাও দেখলাম না। পশ্চিমারা যৌন দৃশ্য দেখায়, কিন্তু তা উপস্থাপনের যে করণকৌশল রয়েছে তাতে শিল্পচিন্তার প্রকাশ থাকে। আমরা অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে এসব বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন অনুভব করি না। শুধু রগরগে দৃশ্য যোগ করলেই হয় না, তা মোক্ষম উপায়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রয়াসও থাকা চাই।
ইউটিউবে এ বিষয়গুলোর তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখলাম পার্থিব রাশেদ নামের এক পরিচালকের একটি সিরিজ নাম ‘শরীরতত্ত্ব’। আরেকটি দেখলাম মৌটুসি অভিনীত একটি সিরিজ। সেটির নাম বলতে রুচিতে বাঁধবে যে কারো।
যদিও মৌটুসি বলেছেন শুধু ওটিটি প্লাটফর্মে দেয়ার কথা বলেই কাজটি করানো হয়েছে। তারপরও বলতে চাই নামকরণের এতো বালকিল্যতার প্রয়োজন কি ছিল আর এমন নামের কাজে যুক্ত হতেও হবে কেনো? অবশ্য এ নিয়ে তিনি একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, পারিশ্রমিক অনেক বেশি তাই সবাই এসবে কাজ করতে চায়।
কথা হলো আমাদের শিল্পরুচিও যদি অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যায় তাহলে আর তো কিছু থাকে না। শিল্পের মৌলিকত্ব অক্ষুন্ন রেখে বাণিজ্য সফল কাজ করাওতো খুব সম্ভব। তার প্রমাণ অসংখ্য রয়েছে। কথা হচ্ছে আমরা সেসব শিল্প সফল কাজের জন্য যে শ্রম দেয়া প্রয়োজন তা দিতে চাই না। একটি নাটক শ্যুট করার আগে কোন রিহার্সাল ছাড়াই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া এখন রীতি। কারণ শিল্পের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন অর্থের। যে অর্থ তৈরি করছে আমাদের অনর্থ।
প্রাসঙ্গিকভাবে নাজিয়া হক অর্ষার কিছু কথা বলা যেতে পারে। তার একটা সাক্ষাতকার ইউটিউবে রয়েছে। তাতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার অর্থ দাঁড়ায় এই, ‘কাজে এক ঘেয়েমি চলে এসছে এবং সেটি ভাঙতে তারা ওয়েব সিরিজে কাজ করতে চান এবং বুঝে শুনে তারা এ কাজটি করছেন।
যারা পড়াশুনা জানেন তারা এগুলোতে কাজ করছেন। যা হইচই, নেটফ্লিক্স কিংবা এমাজন প্রাইমের মতো ওটিটি প্লাটফর্মে দেখা যাবে। ভালো কথা, তিনি ‘বুমেরাং’এ কাজ করেছেন। এমন কাজ করতে কেমন পড়াশুনা জানা দরকার আমার জানা নেই। ফলে পড়াশুনা জানা মানুষ এসবে কাজ করছে বলে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন বোধগম্য নয়।
এরকম আরও কয়েকজন নিজেদের কাজ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নানান কথা বলেছেন। যেমন শিহাব শাহীন ২৭ জুন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, যে দেশে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত, এবং যাদের ৮০ ভাগই তরুণ, সেই দেশে ‘আগস্ট ১৪’ এর গল্পেরই নাকি প্রয়োজন নেই?! কোন গল্প করা যাবে, কোন গল্প করা যাবে না তাও নির্ধারণ করে দিতে চান আপনি?!..হেজিমনি আর কাকে বলে...!!
আসুন দেখি আদনাল ফারুক হিল্লোল-১৮ জুন তার ডাইন আউট উইথ আদনান ফেসবুক পেজে কি বলেছেন। বলেছেন, ‘যে জাতি একজন ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে সে জাতিই সামাজিক অবক্ষয়ের দোহায় তোলে, কি হাস্যকর। ওহে বালক, ভন্ডামি ছাড়ো, তোমার অবক্ষয়ের আর বাকি আছে টা কি।’
ওনাদের মন্তব্যগুলো কেবল তুলে ধরলাম। এ বিষয়ে আমি আর কোন মন্তব্য করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই, আমাদের চিন্তার জায়গাটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা বোঝা যায় এসব কথায়। আমি ওনাদের কাজ দেখি। হিল্লোলের অভিনয় আমার পছন্দ। শিহান শাহীন একজন মেধাবি পরিচালক। তাদের হাত থেকে আমরা শিল্পোত্তীর্ণ কাজ পেতে পারি তা হলপ করে বলতে পারি। তাহলে পাচ্ছি না কেনো?
আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কি এ বিষয়ে কোন গলদ রয়েছে? টেলিভিশন নাটকের নির্মাণ খরচ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আমাদের চলচ্চিত্রের দশাও তেমন ভালো নয়। তাহলে যারা অভিনয় বা এ মাধ্যমকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারা কোথায় যাবেন? শুধু এ বিষয়টি ভাবতে বলবো আমাদের সরকারকে। যদি এ জায়গাটা ঠিক হয় তাহলে আমি বিশ্বাস করি আমাদের এ দৈন্যতা একদিন কেটে যাবে।
বাংলাদেশে আরও বেশি ওটিটি প্লাটফর্ম হওয়া প্রয়োজন। আর শুধু দেশে নয় এর আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সঠিক বিপণন প্রক্রিয়া। পুরো বিশ্বে আমাদের ওটিটি প্লাটফর্ম এবং কাজ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। প্রতিটি কাজের বিভিন্ন ভাষার সাব টাইটেল থাকলে অন্য ভাষার মানুষও আমাদের কাজ দেখবে।
তৈরি হবে নতুন বাজার। ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষার কাজগুলো বিভিন্ন ভাষার সাব টাইটেল নিয়ে দর্শকের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। ফলে তাদের বাজার বিশ্বব্যাপী। আমাদের জন্য এ কাজ করা কঠিন নয়। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন। সাধারণ টেলিভিশন মিডিয়া থেকে হোক কিছুটা আলাদা ওয়েব সিরিজ। তাতে আপত্তি নেই। তবে সেখানে অপটুতা নয়, চিহ্ন থাকুক শিল্পের এবং রুচিবোধের।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির কুবের এবং কপিলা’র যে দৃশ্য আমার পুকুরে দেখি তাকে বলছি ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন। সে দৃশ্য নিয়ে কিন্তু আমরা তর্কে যাই না। কারণ তাতে রয়েছে মন উচাটন করা বুকঝীম ভালো লাগা। কাজগুলো আমাদের চিন্তা করেই করতে হবে।
লেখক: মিলটন রহমান, কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক
e-mail.milton.rahman07@gmail.com
এমবি//