ঢাকা, শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪

সেলিম খানকে হারিয়ে মুহ্যমান সংগীতাঙ্গন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:২৭, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

লাইফ সাপোর্টে নিয়েও শেষ রক্ষা হলো না, না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন দেশের জনপ্রিয় অডিও প্রযোজনা সংস্থা সংগীতার সত্ত্বাধিকারী সেলিম খান। করোনা যুদ্ধে হেরে আজ বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল ৭টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

চার দশকের জনপ্রিয় সংগীত প্রযোজক সেলিম খানের শোকে সংগীতাঙ্গনে নেমেছে স্তব্ধতা- শোকে মুহ্যমান সবাই তাকে নিয়ে জানিয়েছেন নিজ নিজ মতামত।

কণ্ঠশিল্পী আঁখি আলমগীর জানিয়েছেন- আমার ক্যারিয়ারের ১৯টি একক অ্যালবাম আর ৩৫টির বেশি দ্বৈত ও মিশ্র অ্যালবাম- সবগুলো সংগীতার ব্যানারে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আমার আবেগ আর এই মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই।

নিজ ফেসবুক পেজে তিনি আরও লেখেন, সেলিম ভাই এভাবে হুট করে এতো দ্রুত চলে যাবেন, ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আর একটি অ্যালবাম অন্তত করে ২০টির কোটা পূর্ণ করবো। সেটা আর হলো না।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় যখনই সাউন্ডটেক বা অন্য ব্যানারের সঙ্গে অ্যালবাম করার আগ্রহ প্রকাশ করতাম, পরদিনই নতুন অ্যালবামের অ্যাডভানস পাঠিয়ে দিতেন! আবার অ্যালবাম হিট হলে বাসায় গিফট পাঠিয়ে দিতেন। তাও আবার গিফট হলো সোনার চেইন।

তো এভাবেই তাদের মতো অল্প কয়েকজন মানুষ শিল্পীদের সম্মান আর সহযোগিতা করে এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিটাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে। আমরা যারা আজ বড় বড় শিল্পী বা তারকা হয়েছি, তাদেরকে এই দিনগুলোর কথা মনে রাখা দরকার।

সেলিম ভাই, আপনাকে নিয়ে অন্যদিন আরও বড় করে লিখবো। আজ আর মানসিক শক্তি পাচ্ছি না। আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুন।

সংগীতশিল্পী কৌশিক হোসেন তাপস লিখেছেন, বাংলা সংগীতে সেলিম ভাইয়ের কনট্রিবিউশন হিসাবে পরিমাপ করা যাবে না। বাংলা সংগীত যতদিন থাকবে, আপনার কথা মনে রাখবে মানুষ। প্রার্থনা করি, আপনার বিশ্রাম হোক বেহেস্তে।

কণ্ঠশিল্পী আলিফ আলাউদ্দিন লিখেছেন- ১৯৯৭, আব্বুর উদ্যোগে আমার প্রথম অ্যালবাম ‘সেই তুমি এলে’ তৈরি হলো। সেলিম খান চাচা খুব যত্ন নিয়ে অ্যালবামের কভার ডিজাইন, প্রচারণার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমার বয়স অনেক কম। সামনে ও-লেভেল। কেউ কি আমার গান শুনবে? সেলিম চাচা খুব কনফিডেন্ট। বড় পত্রিকায় প্রথম নিজের অ্যালবামের বিজ্ঞাপন দেখে অনেক খুশি হয়েছিলাম। অ্যালবামটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। সংগীতা কোনও কার্পণ্য করেনি আমার অ্যালবাম প্রমোশনে। আমি নতুন বলে কোনও প্রচারণায় পিছিয়ে থাকিনি।

দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ডাকে আমায়’ সমান পরিমাণ ভালোবাসা ও যত্ন নিয়ে সেলিম চাচা প্রকাশ করেছেন। আর ঈদ মানেই তো, কোরবানির বিশাল মাংস চলে আসতো তার বাসা থেকে। উনি এরকমই দিলখোলা মানুষ ছিলেন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।

সংগীতশিল্পী ইমরান লেখেন- সেলিম ভাই আর নেই, বিশ্বাস হচ্ছে না। আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করুক।

সংগীত পরিচালক শওকাত লিখেছেন- শুধু কি মন খারাপ? গত ৬ মাসে হারিয়েছি কাছের দুজন বন্ধুকে। আজ হারালাম আমার সংগীত জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে। যার সাথে কিনা কাজের চেয়ে খুনসুটি করেই আনন্দ ছিল বেশি। মুখের হাসিটা সব সময় একই। আজ ফেসবুকে যতগুলো ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, সেগুলিতেও সেই একই হাসি।

সেলিম ভাই, কেন এমন করলেন? গত কয়েকদিন ধরেই আপনাকে ফোন দিবো ভাবছিলাম। কিছু অভিযোগ, কিছু অনুযোগ- কিন্তু সেগুলো আর বলা হলো না আপনাকে। দুষ্টুমিগুলোও আর করা গেলো না।

গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী জানিয়েছেন- ভাবছিলাম নিজের সুস্থ হয়ে ওঠার খবরটা আজ শেয়ার করবো, কিন্তু সকাল থেকে মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। সংগীতার সেলিম ভাই আজ আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। ক্ষীণ ভঙ্গুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য মহান আল্লাহ্‌তালার উপহার। মনকে বার বার সতর্ক করি, এই জীবন যেন কোনোভাবেই অপচয় না হয়ে যায়।

সংগীত প্রযোজক একেএম আরিফুর রহমান লিখেছেন- সেলিম ভাই কী এমন তাড়া ছিলো হঠাৎ করে এভাবে চলে যাবার! আজ সকালে আমাদের প্রিয় সেলিম ভাই পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। আমরা পুরো অডিও ইন্ডাস্ট্রি শোকে স্তব্ধ। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন ভাই। দোয়া করি আল্লাহ যেন আপনাকে জান্নাতবাসী করেন।

সাংবাদিক ও সংগীতশিল্পী তানভীর তারেক লেখেন- 
মৃত্যু কতো কাছে! কতো পাশেই বসে ঘাপটি মেরে থাকে!!
লুকোচুরি খেলে, সর্বনাশ!
টুক করে নিয়ে যায়
প্রিয় কোনও নিঃশ্বাস!!

চার লাইনের এই ছন্দ লিখে তিনি আরও বলেন, তার বডি ফিট টি-শার্ট আর টেবিলে রাখা অর্ধশত কলম সাজানো নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। সেলিম ভাই বলতেন- তানভীর ভাই বুঝবেন না, বয়স ধরে রাখতে হয়! সত্যিই বয়স ধরে রাখলেন আপনি। সেই একই বেশভূষায় বডি ফিট টিশার্ট পরেই নিয়মিত অফিস করতে করতে চলে গেলেন!! আর কলম?

সেলিম ভাই বলতেন, আপনাগো লাইগা এই কলম রাখি। আগে একটা দুইটা কলম রাখতাম। দেখি যেই গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক আসে.. নিজের মনে কইরা লইয়া যায়। তাই সাজায়া রাইখা দিসি। যার যা খুশি নিয়া যাক।

সেলিম ভাই, আপনার সাথে বেশ কিছু গানেরও কাজ করেছি। এর ভেতরে একটা জেমস ভাইয়ের কাজও ছিল! আপনি ঐদিন আমার পেমেন্টের চাইতে ১০ হাজার টাকা বেশি দিয়েছিলেন! সেলিম ভাই, অনেক দুপুরের বিরিয়ানি আর অনেকগুলা কলমের জন্য ঋণী আপনার কাছে। জানেন তো! আপনার কাছে যদি কারও পৃথিবীতে ঋণ থাকে, আপনি ওপারের অনেক পরীক্ষা থেকে বেঁচে যাবেন! কারণ সেই পরীক্ষা ঋণী ব্যক্তির কৈফিয়তে থাকবে। আপনি এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অনেককেই ঋণী করে গেছেন। ভালো থাকবেন। আসছি আমরাও।

গীতিকবি নিয়াজ আহমেদ অংশু লিখেছেন- ১৯৯৬। মাইলস ছাড়া বাকি সব তারকা ব্যান্ড তখন সাউন্ডটেকের ব্যানারে অ্যালবাম বের করতো। সেই সময় বাচ্চু ভাই এলআরবি’র স্বপ্ন অ্যালবাম সংগীতা থেকে বের করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। সেই সূত্রে আমার সেলিম ভাইয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। সব সময় ফিটফাট। সেলিম ভাই অ্যালবাম প্রকাশ ও প্রচারণা সংক্রান্ত সব কাজেই বিশাল উৎসাহ নিয়ে সহযোগিতা করলো। বাচ্চু ভাইয়ের কোনও কিছুতে না বলেন নাই।

এরপর গান আর প্রচ্ছদ দুই কারণেই উনার সাথে দেশ ছেড়ে আসার আগে পর্যন্ত কম বেশি দেখা সাক্ষাৎ হতোই। হোয়াং হো চাইনিজ রেস্টুরেন্টের এলআরবির ‘স্বপ্ন’ অ্যালবাম-এর প্রকাশনা উৎসবের কথা এখনও মনে হয়, এই তো সেদিন। কি একটা বছর আসলো, হুটহাট পরিচিত লোকগুলো চলে যাচ্ছে।

সংগীতশিল্পী মুহিন খান লিখেছেন- আমার প্রথম অ্যালবাম ‘তোমার জন্য’ বেরিয়েছিল ২০০৮ সালে সংগীতার ব্যানারে। যার কর্ণধার ছিলেন শ্রদ্ধেয় সেলিম খান। সংগীত অঙ্গনের অনেকই তার কাছে ঋণী। একজন অভিভাবককে হারালাম আমরা।

নির্মাতা ও উপস্থাপক আনজাম মাসুদ হতাশা প্রকাশ করে লিখেছেন- আর ভালো লাগছে না। মানুষের জীবনে একমাত্র সত্য মৃত্যু। ২০২০ সাল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সংগীতার কর্ণধার সেলিম খানের মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনে আজ শোকের ছায়া। অনেক স্মৃতি আপনার সাথে আমার। শুধু একটি কথাই বলি জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনের ‘দুচোখে ঘুম আসে না’ তুমুল জনপ্রিয় একটি গান। সংগীতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর দুই বছরেও গানটি জনপ্রিয়তা পায়নি, তখন আমি আমার ‘আজকাল’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচার করেছিলাম, বাকি ইতিহাস আপনাদের জানা। ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় সেলিম ভাই।

সেলিম খানের প্রয়াণে এভাবে শোক জানিয়েছেন দেশের সিংহভাগ সংগীতশিল্পী। সাংগঠনিকভাবে শোক প্রকাশ করেছে গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশ, সিঙ্গার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি