যেভাবে ‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পী
প্রকাশিত : ১১:৫৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সঙ্গীতাকাশে একের পর এক নক্ষত্রের পতন। কিংবদন্তী লতা মঙ্গেশকরের বিদায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তাকে অনুসরণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তারপর এক সন্ধ্যা পেরোতেই চলে গেলেন বাঙালিকে ‘ডিস্কো ডান্সারের’ সুরে মাতিয়ে রাখা বাপ্পী লাহিড়ী।
বুধবার সকালে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ৬৯ বছর বয়সে প্রায়াত হন ‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পী।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক পরিবারে জন্ম বাপ্পী লাহিড়ীর। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের জনপ্রিয় গায়ক, মা বাঁশরী লাহিড়ী ছিলেন একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়িকা, যিনি শাস্ত্রীয় ঘরাণার সঙ্গীত এবং শ্যামা সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন।
উপমহাদেশের সঙ্গীতের আরেক দিকপাল কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পীর সম্পর্কে মামা। তাই মা-বাবার একমাত্র সন্তান বাপ্পী জন্ম থেকেই পেয়েছিলেন সূরের পরিবেশ। গানের প্রতি তার আজন্ম টান থাকাটাই স্বাভাবিক।
তিন বছর বয়সে তবলায় হাতেখড়ি, সঙ্গীত সাধনাও শুরু সেই সময়, মা-বাবার হাত ধরেই।
এরপর ১৯ বছর বয়সে দাদু (১৯৭২) বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন বাপ্পী। এরপরই মুম্বাইয়ে গান নিয়ে তার পেশা জীবন শুরু।
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্ম আলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ীর, যদিও পরবর্তীতে সঙ্গীত জগতে বাপ্পী নামেই বেশি পরিচিত পেয়েছেন তিনি।
বাপ্পী লাহিড়ী রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছিলেন। বিজেপিতে যোগ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে ভোটেও লড়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে কখনই স্বস্তি বোধ করেননি, যতটা ছিলেন তার চিরচেনা সঙ্গীত জগতে।
আমির খানের বাবা তাহির হুসেনের ‘জখমি’র সঙ্গে বলিউডের সংগীত জগতে নিজের আত্মপ্রকাশ দাপটের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন এই বাঙালি শিল্পী।
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গত বছর মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাপ্পী। পরে সেরে উঠলেও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কন্ঠস্বর হারিয়েছিলেন, এমন গুজবও রটেছিল।
যদিও ছেলে বাপ্পা লাহিড়ী সেই সময় জানিয়েছিলেন, কোভিড পরবর্তী জটিলতার কারণে তাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিল।
সবশেষ গেল নভেম্বরে ‘সারেগামাপা’র মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বাপ্পী। আর শেষবার প্রকাশ্যে এসেছিলেন সালমান খানের বিগ বস-১৫ এর মঞ্চে।
ব্যক্তিগত জীবন
স্ত্রী চিত্রাণী, মেয়ে রিমা এবং ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে ছিল বাপ্পী লাহিড়ীর সাজানো ঘর।
অলঙ্কারের ভক্ত বাপ্পীর বাহারি পোশাকের সাথে স্বর্ণের অলঙ্কার এবং কালো চশমার প্রতিও দুর্বলতা ছিল।
সঙ্গীত জীবন
১৯ বছর বয়সে পেশা হিসেবে গানের জীবনে পা রাখেন বাপ্পী। ১৯৭৩ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত ‘নানহা শিকারী’ ছবিতে তিনি প্রথম গান রচনা করেন।
এরপর তাহির হুসেনের ‘জখমি’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে কাজ করেন।
‘সম্ভব কিছু নয়’ গানে মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান তিনি।
তারপরের চলচ্চিত্র হিসেবে ‘চালতে চালতে’ ছবিটির গানও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘সুরক্ষা’ ছবিতে গান গেয়ে সঙ্গীতকার হিসেবে জনপ্রিয়তা পান।
মিঠুন চক্রবর্তীর ডিস্কো নাচের চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০'র দশকে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পী লাহিড়ী একসাথে বেশ কিছু ডিস্কো চলচ্চিত্রে কাজ করেন।
এছাড়াও তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দী চলচ্চিত্রের গানে অংশ নিয়েছেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি নিজেকে 'ডিস্কো কিং' নামে পরিচিতি পান। এ ছাড়া বাংলায় ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘অমর প্রেম’সহ একাধিক ছবিতে সুর দিয়েছেন।
বাপ্পী ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ১৯৯০'র দশকে দূরে সরে যান। পরে প্রকাশ মেহরার 'দালাল' ছবিতে স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন।
২০২০ সালে তার শেষ গান ‘বাগি- ৩’ এর জন্য।
গানের ধাঁচ
বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় চলচ্চিত্রে ভারতীয় ধাঁচে ডিস্কো সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তার রচিত অনেক গান কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলের কণ্ঠে চলচ্চিত্রের পর্দায় এসেছে। বিজয় বেনেডিক্ট এবং শ্যারন প্রভাকরকেও তিনি সঙ্গীতে অভিষেক ঘটান।
বাপ্পী যেসব চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে অন্যতম এক বার কহো (১৯৮০), সুরক্ষা, ওয়ারদাত, আরমান, চলতে চলতে, কমাণ্ডো, ইলজাম, পিয়ারা দুশমন, ডিস্কো ড্যান্সার, ড্যান্স ড্যান্স, ফিল্ম হি ফিল্ম, সাহেব, টারজান, কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি, ওয়ান্টেড: ডেড অর এলাইভ, গুরু, জ্যোতি, নমক হালাল, শরাবী (১৯৮৫: ফিল্মফেয়ার সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার), এইতবার, জিন্দাগী এক জুয়া, হিম্মতওয়ালা, জাস্টিস চৌধুরী, নিপ্পু রাব্বা, রোদী ইন্সপেক্টর, সিমহাসনম, গ্যাং লিডার, রৌদী অল্লাদু, ব্রহ্মা, হাম তুমহারে হ্যায় সনম এবং জখমী। এছাড়া তিনি মালায়ালম চলচ্চিত্র ‘দ্য গুড বয়েজের’ সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন।
এসবি/