ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও মডেলিং ছাড়েননি এই তরুণী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

লিলিয়ান ডি’মেলো

লিলিয়ান ডি’মেলো

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। বেঙ্গালুরুর একটি অভিজাত পাড়ার বসার ঘরে জড়ো হয়েছেন প্রায় এক ডজন শিল্পী। সকলেই প্রস্তুত নিজেদের ক্যানভাসের সামনে। তাদের সামনে নির্দিষ্ট ‘পোজ’-এ বসে পড়লেন এক তরুণী।

পেলব দেহে সুতোর লেশমাত্র নেই। তা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র আড়ষ্ট নন। ঘণ্টা তিনেকের জন্য সে রকম সাবলীল ভঙ্গিমায় বসে থাকতে হবে তাকে। ধীরে ধীরে প্রতিটি ক্যানভাসে ফুটে উঠবে লিলিয়ান ডি’মেলোর নগ্ন দেহ।

লিলিয়ান পেশায় ন্যুড মডেল। শিল্পের খাতিরে যিনি পোশাক উন্মুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি চিত্রশিল্পের পড়ুয়া, স্থাপত্যকার বা নামজাদা শিল্পীর সামনে তাদের সৃষ্টির প্রেরণা হয়ে বসেন।

বেঙ্গালুরুর গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশবিদেশের শিল্পীমহলে বেশ পরিচিত নাম ২৫ বছরের লিলিয়ান। তবে সে পরিচিতি লাভের সঙ্গে মিশে রয়েছে তার লড়াইয়ের কাহিনিও। নীতিপুলিশদের চোখরাঙানি থেকে নিজের পরিবারের কাছে ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার গল্প। ন্যুড মডেল মানেই যে যৌনকর্মী— এ ধারণার মুখোমুখিও হওয়া। যে জন্য হারাতে হয়েছে ভাড়াবাড়ির আশ্রয়ও।

ন্যুড মডেলিংকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার পথে বর্হিজগতের পাশাপাশি তার নিজেরও বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন লিলিয়ান। এক সময় তাকে স্থূলকায়া, কম উচ্চতার বলেও কটাক্ষ করেছে বিজ্ঞাপনী জগৎ। তবে সে সব বাধা পেরিয়েছেন লিলিয়ান। নিজের দেহ নিয়ে হীনমন্যতা কাটিয়ে জুটিয়েছেন আত্মবিশ্বাস।

এ দেশের মেয়ে নন লিলিয়ান। মঙ্গোলিয়ান বাবা এবং ফিলিপিনো মায়ের সন্তানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ওমানের সালালায়। এ দেশে এসেছিলেন কলেজের পড়াশোনা করতে। সেটি ছিল ২০১৩ সাল। কর্নাটকের উদিপিতে থেকে কলেজের পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। বছর দুয়েক পরে এক জুলাই মাসে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে ওঠেন।

কলেজ জীবনের সময় থেকেই শুনতেন, তিনি নিখুঁত নন। সংবাদমাধ্যমের কাছে লিলিয়ান বলেন, ‘‘কলেজের পড়াশোনার পাশাপাশি মডেলিং এবং টিভির বিজ্ঞাপনে অভিনয়ও শুরু করেছিলাম। তবে প্রায়শই আমাকে কাজ দেওয়া হত না। বিজ্ঞাপনী জগতের মানুষরা বলতেন, আমি স্থূল। মডেল হিসেবে উচ্চতাও ‘সঠিক’ নয়— এ সবই শুনতে হয়েছে।’’

বিজ্ঞাপনের ‘নিখুঁত’ মাপে খাপ খাওয়াতে পারেননি লিলিয়ান। এক সময় নিজের শরীর নিয়েও সহজ হতে পারেননি। তার কথায়, ‘‘এ সব শুনে নিজের সম্পর্কে অস্বস্তি হতে শুরু করেছিল। মডেলিং করাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম।’’

এক সময় ফেসবুকে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পীদের গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় হয় লিলিয়ানের। তাতে ফিগারেটিভ আর্ট, পেন্টিং এবং স্থাপত্য নিয়ে আলোচনার সময় নিজেকে অন্য ভাবে দেখতে শুরু করেন।

লিলিয়ান বলেন, ‘‘মহিলাদের স্বাভাবিক ভঙ্গি যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শিল্পীরা, তা দেখে নিজেকে মেলাতে শুরু করেছিলাম। সে সময় মনে হয়েছিল, দেখাই যাক না এক বার আর্ট মডেল হয়ে! ওখানে তো আর আমার দেহ নিয়ে কাটাছেড়া বা বিচার করা হবে না!’’

২০১৮ সালের এপ্রিলে একগাদা শিল্পীর ক্যানভাসের পাশে প্রথম বসেন লিলিয়ান। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম বার পোশাক উন্মুক্ত করে পোজ দেওয়ার মুহূর্তে একটা অদ্ভুত শান্তি পেয়েছিলাম।’’ নিজের দেহের সঙ্গেও সখ্য গড়ে উঠেছে লিলিয়ানের। মনে হয়েছিল, এ বার আর তাঁর দেহ নিয়ে কোনও অবাস্তব চাহিদার মুখোমুখি হতে হবে না।

কলেজের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পরের বছর দুয়েক ধরে কপিরাইটার হিসাবে কাজ চালিয়ে গিয়েছেন লিলিয়ান। সপ্তাহান্তে চলছিল ন্যুড মডেলিংয়ের কাজও।

অন্তরে স্বস্তি ফিরলেও বহির্জগতে বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন লিলিয়ান। এক বার ন্যুড মডেলিং করা নিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে অনলাইনে কথাবার্তার সময় আত্মীয়দের নজরে পড়ে যান। লিলিয়ান বলেন, ‘‘আমার পরিবার বেশ রক্ষণশীল। ন্যুড মডেলিং করার কথা জানতে পেরে আমাকে চেপে ধরেন আত্মীয়েরা। সত্যিই আমি ন্যুড মডেল কি না, তা জানতে চান। ওঁদের কাছে স্বীকার করি। পরিবারের কাছে সে কথা জানাজানি হতেই আমাকে শাসানো হয়েছিল— হয় ন্যুড মডেলিং বন্ধ করো, না হয় বাড়ি ছাড়ো!’’

ন্যুড মডেলিং ছাড়তে রাজি হননি লিলিয়ান। ফলে মাথার উপর থেকে পরিবারের আশ্রয় সরে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে অফিসে থাকতে শুরু করেন। অবশেষে ২০২০ সালের গো়ড়ায় পশ্চিম বেঙ্গালুরুতে একটি ভাড়াবাড়ি জুটিয়ে নেন তিনি।

২০২০ সালের মার্চে দেশ জুড়ে লকডাউন চলাকালীন অনলাইনে ন্যু়ড মডেলিং করতেন লিলিয়ান। ধীরে ধীরে শিল্পীমহলে নামও বাড়ছিল। ওই বছরের অগস্টে কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। তবে সেখানেও বিপত্তি। কেউ এক জন তার ভাড়া বাড়ির মালিকের কাছে লিলিয়ানের নগ্ন অবস্থার একটি পোর্টেট পাঠিয়ে দেন। এ দেশের সমাজে ন্যুড মডেলদের কী চোখে দেখা হয়, সে বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনিয়েছিলেন ভাড়া বাড়ির মালিক। পাশাপাশি, এক মাসের মধ্যে ভাড়া বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। লকডাউনের সময় ভাড়া বাড়ি খুঁজতে বার হয়েছিলেন লিলিয়ান।

এক সময় ভাড়া বাড়িও পেয়ে যান লিলিয়ান। ২০২১ সালে তার হাতে পরের কাজ। অবশেষে কপিরাইটারের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সে সময় থেকেই পুরোদমে ন্যুড মডেলিং শুরু করেন লিলিয়ান।

লিলিয়ান বলেন, ‘‘কাজের পর কাজ জুটলেও সব সময়ই সিঁটিয়ে থাকতাম। ন্যুড মডেলিংও যে আর্টের অঙ্গ, তা অনেকেরই বোধগম্য হবে না। একে যৌনপেশার সঙ্গে তুলনা করাও বন্ধ হবে না। ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা হত। এক সময় ইনস্টাগ্রামে নিজের প্রোফাইলও প্রাইভেট করে দিই। একই সঙ্গে কেবলমাত্র নামজাদা শিল্পীদের জন্যই কাজ করা শুরু করেছিলাম। যাতে আর কারও লক্ষ্য না হয়ে উঠি!’’

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি