ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সাবরিনা: দুই নারীর খোলসে একটি রাজনৈতিক গল্প

অদিতি দাস

প্রকাশিত : ১৩:৪০, ১০ এপ্রিল ২০২২ | আপডেট: ১৪:১৩, ১০ এপ্রিল ২০২২

ওয়েব সিরিজ 'সাবরিনা' দেখলাম সম্প্রতি। পর্দায় সাবরিনা নামের দুই নারীর গল্প বলা হলেও আসলে দেখে মনে হয়েছে- এতো এই দেশে অনেক নারীর সাথে প্রতিনিয়তই ঘটে যাওয়া ঘটনা! দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈবাহিক, পেশাগতসহ নানা কারণে কতভাবেই না নারীদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে। 

সিরিজটিতে দুইজন আপসহীন নারীকে দেখানো হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, যারা আপস করেনা, তারা বোকা। দু’টি চরিত্রের এই দিকটির সাথে নিজেরও মিল খুঁজে পেলাম।

সিরিজে ভিক্টিম ‘সাবরিনা’ চরিত্রে সাবলীল অর্ষা। আগুনে দগ্ধ হওয়া এই সাবরিনাকে দেখে ফেনীর নুসরাতের কথা মনে পড়ে গেল। 

স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় স্বামী শওকত (ইন্তেখাব দিনার) যখন অর্ষাকে (ভিক্টিম সাবরিনা) চড় মারেন, তখন কাঁদতে কাঁদতে তিনি একটি সংলাপ বলেন, যা মনে গেঁথে আছে। সংলাপটি এমন, 'তোমার মেয়েতো জানেনা যে সে আসলে কিছুই ধরে রাখতে পারবে না, না কালার বক্স, না জমি, না আত্মসম্মানবোধ।'

বরের হাতে মার খাওয়া গৃহিনী, সহজ-সরল এই নারী কিন্তু অন্যায়ের সাথে সমঝোতা করেননি, অর্থাৎ স্বাবলম্বী না হলেও আপসহীন তিনি।

বর বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান, যে কারণে তিনি নিজেই বিপদে পড়ে যান। শওকত একজন ক্রাইম রিপোর্টার, নিজের মেয়ের প্রতি স্নেহশীল, বউকেও ভালোবাসেন। কিন্তু আর্থিক টানাপড়েন বা পেশাগত সমস্যা, সন্দেহপ্রবণ মানসিকতার কারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন। এরকম কিন্তু ঘটে চলেছে এই সমাজে।

ইন্তেখাব দিনার বরাবরই সুঅভিনেতা, এখানেও ভালো করেছেন। যদিও এ ধরনের চরিত্রে তাকে প্রথমবার দেখলাম। সিরিজটিতে শওকত আর বাহাদুর (হাসান মাসুদ) চরিত্রের কেমিস্ট্রি ভালো লেগেছে।

ডক্টর সাবরিনা চরিত্রটিরও দু’টি রূপ। এই চরিত্রটি রূপায়ন করেছেন মেহজাবীন। তিনি শক্তিশালী হলেও কখনো কখনো ভালনারেবল। ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করার সময় উনার সাথে পেশাগত কারণে কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যেটা পুরোপুরি খোলাসা করা না হলেও বোঝা গেল, তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে তিনি মফস্বলের একটি সদর হাসপাতালে কাজ করেন।

ভিক্টিম সাবরিনার প্রতি তার যে মমত্ব, কারা তাকে আগুনে পোড়াল, ধর্ষণ করল- এসব জানতে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তিনি চরম ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। প্রথমে মনে হচ্ছিল তিনি বাড়াবাড়ি করছেন। পরে জানা গেল, ছোটবেলায় তিনি তার বড় বোনকে অন্যায়ের শিকার হতে দেখেন, বাবা-মার সহায়তা না পেয়ে বোনটি আত্মহত্যা করে। সেই ঘটনায় আসলে ডক্টর সাবরিনা ট্রমাটাইজড, তিনি নিজেই একজন রোগী। তাই ভিক্টিম সাবরিনাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে তিনি বদ্ধপরিকর। ড. সাবরিনার মধ্যে রয়েছে অস্থিরতা, কষ্ট, ক্ষোভ। নিজেকে শান্ত করতে ঢকঢক করে গ্লাসের পর গ্লাস জল খাচ্ছেন, এই দৃশ্য অনেকদিন মনে থাকবে। মেহজাবীন অসাধারণ অভিনয় করেছেন। মেকআপবিহীন একেবারে ন্যাচারাল লুকের মেহজাবীনকে পাওয়া গেল এখানে।

বেবি ভাবির চরিত্রটি করেছেন রুনা খান, যিনি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, সাবলেট দেয়া কাপলের দরজায় আড়ি পেতে তাদের রোমান্টিক মুহূর্ত জানার চেষ্টা করেন, এমনকি কষ্ট কমাতে ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও কেক খাচ্ছেন এরকম দৃশ্যও দেখা গেল। চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি। ওয়েবসিরিজের বাকি চরিত্রগুলোও যার যার জায়গা থেকে ভালো করেছেন।

সারা দুনিয়াতেই নারীকেন্দ্রিক কাজ খুব কম দেখা যায়। এরকম কাহিনী নিয়ে কাজ করার জন্য আশফাক নিপুণকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কাহিনী খুব ধীরগতিতে আগালেও দেখতে বসে কেউ একঘেঁয়েমিতে ভুগবেন না বলা যায়। 

এই নির্মাতার 'মহানগর' ওয়েব সিরিজেও রাজনৈতিক বিষয় কিছুটা ছিল, কিন্তু 'সাবরিনা'র গল্প পুরোটাই রাজনৈতিক। মফস্বল সাংবাদিকতার সমস্যার বিষয়টিও দক্ষভাবে দেখানো হয়েছে। পরিচালক আসলেই খুব সাহসী। আরও ভালো কাজ চাই আপনার থেকে, বিশেষ করে নারীকেন্দ্রিক কাজ করুন, প্রত্যাশা বেড়ে গেল। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, এডিটিং, ফ্রেম সবকিছুই ভালো লেগেছে, কিছু কিছু সংলাপ অসাধারণ ছিল।

সিলেট আমার জন্মস্থান। সিরিজের দৃশ্যধারণ হয়েছে সিলেটে। অগ্নিদগ্ধ সাবরিনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে এরকম নাটকীয়তায় ভরপুর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে ওয়েব সিরিজটি শুরু হয়। তেমনি 'সাবরিনা'র একদম শেষ দৃশ্যে চা বাগানের রাস্তায় দেখা গেল মেহজাবীনকে। দৃশ্যটি দারুণ ছিল।

অনেকগুলো প্রশ্নের উদ্রেক করে শেষ হয়ে গেল সাবরিনা সিজন-১। অপেক্ষায় আছি সিজন-২ এর জন্য।

লেখক: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস। 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি