তৃণমূল কংগ্রেসের নায়িকা প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক
প্রকাশিত : ১৯:২০, ১৫ মার্চ ২০১৯
ভারতের আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এবার দুজন নতুন নায়িকাকে মনোনয়ন দিয়েছে৷ যাদবপুর কেন্দ্রে মিমি চক্রবর্তী ও বসিরহাট কেন্দ্রে নুসরত জাহান৷ এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এখন সরগরম৷
দুজনের মধ্যে অনেক মিল৷ দুজনই কমবয়সি, দুজনই সুন্দরী এবং দুজনই রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ৷ মিমি চক্রবর্তী যাদবপুরের যে কেন্দ্র থেকে নির্বাচন করছেন সেটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কারণ এটি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কেন্দ্র৷ তার আগে এটি ছিল লোকসভার অধ্যক্ষ, সাংসদ এবং সিপিএম দলের প্রথম সারির নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচন কেন্দ্র৷
১৯৮৪ সালে এই যাদবপুর কেন্দ্রেই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে খবরের শিরোনাম হন মমতা ব্যানার্জি নামে কংগ্রেসের এক আপাত অখ্যাত প্রার্থী৷ বিরোধী নেত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির বিস্ময়কর উত্থানের সেই শুরু৷ সেই কেন্দ্রে মমতা ব্যানার্জি এবার দলের প্রার্থী হিসেবে বেছে নিলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে, টিভি সিরিয়াল এবং সিনেমার বাইরে যার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই৷
একই কথা বলা যায় মূলধারার বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার আরেক অভিনেত্রী নুসরৎ সম্পর্কেও৷ তাঁকে মমতা দাঁড় করাচ্ছেন রাজ্যের আরেকটি কেন্দ্র বসিরহাটে৷
বিস্তর আলোচনা
প্রার্থী হিসেবে নবীন এই দুই নায়িকাকে বেছে নেয়ায় বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে৷ যদিও এমন নয় যে এই প্রথম কোনো অভিনেত্রী নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন৷ মুনমুন সেন এবং শতাব্দী রায়, দুই অভিনেত্রী আগেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জিতেছেন এবং সংসদে গেছেন৷ এবারও এরা দুজন লোকসভায় প্রার্থী, যেমন নিজের জেতা কেন্দ্র থেকেই ফের প্রার্থী হচ্ছেন এসময়ের বাংলা সিনেমার নবীন নায়ক দেব৷ অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়, অভিনেতা তাপস পালও সংসদে গেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে, শারীরিক কারণে যাঁদের দুজনের কেউই এবার প্রার্থী হননি৷ বামপন্থিরাও অনিল চ্যাটার্জি, অনুপ কুমার, বিপ্লব চ্যাটার্জির মতো মানুষদের অতীতে দলের প্রার্থী করেছেন, যাঁদের সামাজিক পরিচিতি ছিল অভিনেতা হিসেবে৷ যদিও তাঁরা সবাই যুক্ত ছিলেন বামপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, কিন্তু অভিনেতারা প্রার্থী হতে পারবেন না, এই প্রশ্ন তখন ওঠেনি, যতটা এখন উঠছে৷
বিশেষত মিমি এবং নুসরতের প্রার্থীপদ নিয়ে রীতিমত তোলপাড় হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়৷ এবং সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ প্রায়ই শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছে৷ দুই অভিনেত্রীর পুরনো ফটো শুটের ছবি খুঁজে বের করা হচ্ছে, যেখানে তাঁরা শরীর দেখানো খাটো পোশাক পরে আছেন, বা দর্শকের দিকে চুমু ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করছেন৷ তাঁদের পুরনো সিনেমার দৃশ্য খুঁজে বের করা হচ্ছে, যেখানে হয়ত তাঁদের সংলাপ ছিল অশ্লীল৷ এমনকি অন্য কারও নগ্ন ছবিতে এঁদের দুজনের মাথা কেটে বসিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ ‘মর্ফ` করা ছবিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে৷ গোটা বিষয়টা সব অর্থেই মাত্রা ছাড়াচ্ছে৷
‘যৌন রসিকতা সবসময়ই ছিল’
কবি বুবুন চট্টোপাধ্যায় মনে করছেন, সোশাল মিডিয়া যেহেতু একটা অবারিত ক্ষেত্র, চাইলেই যে কেউ সেখানে নিজের মতামত জানাতে পারে, বিষয়টা প্রায়শই সভ্যতা, শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়৷ আর ‘‘মহিলাদের নিয়ে এই যে একটা যৌন রসিকতা, এটা তো আমাদের দেশে সবসময়ই ছিল৷ এবং সেটা এত বিকৃত, যে সেটাও সামাজিক জায়গায় একটা ছাপ ফেলছে,`` বললেন বুবুন৷
রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন বুবুন, যে ‘নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেহ নাহি দিবে অধিকার`৷ রবীন্দ্রনাথের সময়ও সেই অধিকার নারীরা পায়নি, এখনও সেই অধিকার কেউ দেবে না৷ এটা চলতেই থাকবে৷ বরং মানুষের রুচি এখন যেহেতু একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, নোংরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ কাজেই বুবুন সখেদে জানাচ্ছেন, যে তিনি খুব আশ্চর্য হচ্ছেন না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কষ্ট পাচ্ছেন৷
ওড়িশি নৃত্যশিল্পী দেবমিত্রা সেনগুপ্ত যেমন বুঝতেই পারছেন না, কোন নিয়মে বলা আছে যে অভিনেত্রীরা রাজনীতি করতে পারবেন না! তাঁর যুক্তি, যে-কোনো পেশা থেকেই যেমন লোকে রাজনীতিতে আসতে পারেন, তেমন শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্র থেকেও আসতে পারেন৷ কারণ শিল্পীদেরও অন্তরের তাগিদ থাকতে পারে মানুষের জন্য কিছু করার৷ আর অন্য পেশার লোক হলে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা থাকবে না, এই অপযুক্তির বিরুদ্ধেও পালটা তর্ক তুলেছেন দেবমিত্রা৷
তিনি বললেন, ‘‘আমরা যখন স্কুল-কলেজ থেকে রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হই, তখন সবাই আমরা একরকম পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে যাই৷ সেখান দিয়ে যেতে যেতে কেউ হয়ত পরে ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়, কেউ অন্য কিছু, কিন্তু সেখান থেকেই আমাদের রাজনীতির হাতেখড়ি৷ যার ইচ্ছে হবে, যে-কোনো পেশায় থেকেই সে রাজনীতি চালিয়ে যেতে পারে৷``
মিমি এবং নুসরতের খোলামেলা ছবি, বা সিনেমার দৃশ্যের ক্লিপ ছড়িয়ে দেওয়াও খুব হাস্যকর মনে হয়েছে দেবমিত্রার কাছে৷ কারণ সেগুলো তাঁরা পেশার প্রয়োজনে, অভিনীত চরিত্রের প্রয়োজনে করেছিলেন৷
পেশায় শিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা দাশগুপ্ত মনে করেন, এই বিতর্কের পেছনে আছে সমাজের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গী, যে যাঁরা অভিনয় করেন, মেধা বা বুদ্ধির সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না এবং রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁদের থাকবে না৷ আর এখানে মিমি, নুসরতের ব্যাপারে এত আপত্তি, তার গূঢ়তর কারণ হলো, সিনেমায় মেয়েদের যতটা না স্বাধীন সত্তা হিসেবে দেখানো হয়, তার থেকে বেশি বিনোদনের উপাদান করে তোলা হয়৷ যে কারণে আগেই সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজনীতিতে এসেছেন, সে নিয়ে যত না কথা হয়েছে, মিমি-নুসরৎকে নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি হচ্ছে৷
খুব সোজাসাপ্টা একটা কথা বললেন সঙ্ঘমিত্রা, ‘‘অভিনেত্রী মানেই যে তাদের একাধিক প্রেম, বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সে সত্যিকারের সম্পর্ক হোক, বা যাই হোক - আমরা এখনও সেটা হজম করতে শিখিনি৷ যে চুরি করে, যে জালিয়াত, বা মিথ্যেবাদী, এগুলোর সঙ্গে রাজনীতিকে আমরা যুক্ত করতে পেরেছি এবং মেনে নিতে শিখেছি৷ কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে ওগুলো এখনও মানা যায়নি৷ সেটা আমাদের মানসিক রক্ষণশীলতা৷`` ডয়েচে ভেলে
এসি