ক্যানসার জয় করে শুটিংয়ে ফিরলেন অভিনেত্রী
প্রকাশিত : ২২:৪০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ২২:৪২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯
দুরারোগ্য অসুখ এক সময় স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল তাঁর জীবনের পথ। লড়াই করলেও ফিরতে পারবেন কি না সে চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল পরিবার-পরিজন সকলকেই। দিনরাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের মেক আপ ভ্যান, শুটিং ফ্লোর, স্বামী ও ছেলের কথাই ভাবতেন নব্বইয়ের দশকে পুরুষের হৃদয়ে কাঁপন ধরানো এ অভিনেত্রী।
যদিও তাঁর তীব্র প্রাণশক্তি ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে ক্যানসার। মনের জোর ও সাহসকে অবলম্বন করে ক্যানসার জয়ীদের তালিকায় এখন উঠে এসেছে তাঁর নামও। তিনি সোনালি বেন্দ্রে। যাঁর দুরন্ত ফেরা বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে পারে বিশ্বের সব ক্যানসার আক্রান্তকেই।
১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি মুম্বইয়ের এক মারাঠা পরিবারে জন্ম হয় সোনালির। ছোটবেলা থেকেই নাচ-গান ও অভিনয়ের প্রতি অদম্য টান ছিল তাঁর। মুম্বইয়ের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় ও ঠাণের হলি ক্রস কনভেন্ট থেকে স্কুলের পাঠ শেষ করে মুম্বইয়ের রাম নারায়ণ রুজা কলেজ থেকে স্নাতক অর্জন করেন।
স্কুল শেষ করার পর থেকেই মডেলিং করতে শুরু করেন সোনালি। কেরিয়ার মডেলিং দিয়ে শুরু হলেও এই সময়ই টুকটাক কিছু বিজ্ঞাপনী ছবিতেও কাজের অফার আসতে থাকে।
তাঁর ক্যামেরার সামনে সপ্রতিভ আচরণ, অভিনয় দক্ষতার জেরে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই চলচ্চিত্র পরিচালক কে রবিশংকরের নজরে আসেন তিনি। ১৯৯৪-তে মুক্তি পায় ‘আগ’। সেখানে গোবিন্দা ও শিল্পা শেট্টির সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেন সোনালি। এ ছবিই তাঁকে এনে দিল সেরা নতুন মুখের পুরস্কার। এর পর পরই আসতে থাকে বলিউডি ও দক্ষিণী নানা চলচ্চিত্রের অফার।
১৯৯৬ সালে মাইকেল জ্যাকসন যখন ভারতে আসেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে বলিউডের পক্ষ থেকে ভার দেওয়া হয় সোনালিকে। তত দিনে ‘রক্ষক’, ‘ইংলিশ বাবু দেশি মেম’, ‘আপনে দম পর’, ‘সপুত’র মতো উপহার দেন। প্রতিটি ছবির টাইটেল কার্ডেই নতুন এ নায়িকার নাম যোগ করত আলাদা আবেদন।
‘নব্বইয়ে সোনালি বেন্দ্রে মানেই যেন এক আলাদা আবেদন! ‘নরাজ’, ‘জখম’, ‘অঙ্গারে’ এ সব ছবি তো চলতই সোনালির নামে। সে শুধু মাত্র নায়িকা ছিল এমন নয়, কিন্তু তাঁর অভিনয়ের প্রসাদগুণে অনেক তাবড় অভিনেত্রীর সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারতেন। এক সহজাত সৌন্দর্যও ছিল, যা নয়নাভিরাম।’ সোনালি বেন্দ্রের অভিনয় নিয়ে এমন মুদ্ধকর মন্তব্য করেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
১৯৯৯ সালে দুই তামিল ছবি ‘কধালার ধিনাম’ ও ‘কান্নোদু কানবাথেলাম’এ অভিনয় করেও দক্ষিণী চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় বেশ নাম করেন। এরপর ২০০০ সালে ‘চল মেরে ভাই’তে তাঁর ক্যামিও চরিত্রটিও সিনেমাপ্রেমীদের মন কাড়ে। ‘হমারা দিল আপকে পাশ হ্যায়’ ছবির জন্য সেরা সহ-অভিনেত্রীর পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হন।
শুধু হিন্দি ও তামিল নয়, ২০০১ সালে তেলুগু ছবির ডেবিউ করেন সোনালি। তেলুগু ফিল্ম-ইতিহাসে এই ‘মহেশ বাবু’ ছবিটি আজও বিখ্যাত।
শুধু বড়পর্দাই নয়, টেলিদুনিয়াতেও সোনালি ঢুকে পড়েন ২০০১ সালে। এক বেসরকারি চ্যানেলের নাচের রিয়েলিটি শো সঞ্চালনার কাজ দিয়েই শুরু হয় তাঁর টেলিদুনিয়ার ডেবিউ। এরপর গান ও নানা প্রতিভার ট্যালেন্ট হান্ট শো‘র সঞ্চালক ও বিচারক হিসেবে সোনালিকে দেখা গিয়েছে।
মাঝে ২০০২ সালে বহু দিনের বন্ধু পরিচালক গোল্ডি বেহলকে বিয়ে করেন সোনালি। ২০০৪ সালে জন্ম নেয় তাঁদের পুত্র সন্তান। এই সময় সংসার সামলে ছেলেকে একটু বড় করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সোনালি। পরে ২০১২ সালে অক্ষয় কুমারের বিপরীতে ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই দোবারা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফিরে আসেন সোনালি। তারপর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফিল্ম ও টেলিফিশন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জনপ্রিয় এ নায়িকা। রোমান্স, অ্যাকশন এবং কমেডি মিলিয়ে ইতোমধ্যেই প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি বলিউডি ছবিতে অভিনয় করেছেন সোনালি।
বাধ সাধল ক্যানসার। ২০১৮ সালের জীবনের এই কঠিন অধ্যায়েও এতটুকু মনোবল হারাননি তিনি। পাশে পেয়েছিলেন গোটা পরিবারকেই। নিউইয়ার্কে চিকিৎসা চলাকালীন সোনালির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন একাধিক বলিউড তারকা। কখনও প্রিয় বন্ধু সুজান খান বা গায়ত্রী জোশীর সঙ্গে ছবি শেয়ার করেছিলেন সোনালি। কখনও বা অনুপম খের, প্রিয়ঙ্কা চোপড়াদের দেখা গিয়েছে সোনালির সঙ্গে। তাঁর হার না মানা মানসিকতাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন সকলে।
ক্যানসারের কেমোথেরাপি কেড়ে নিয়েছিল সোনালির মাথার চুল। কিন্তু সে অবস্থাতেও প্রকাশ্যে এসেছেন তিনি। নিজেকে লুকিয়ে রাখেননি। বরং সাহস দিয়েছেন অন্যদেরও। তাঁকে দেখে যাতে অন্য ক্যানসার আক্রান্তেরা সাহস সঞ্চয় করতে পারে, সেই চেষ্টাই করেছেন প্রতিদিন। সোনালির এমন ভূমিকাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন সকলে।
পুরোপুরি সুস্থ না হলেও একটু ভাল হতেই শুটিং ফ্লোরেও ফিরেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক কিছু ঘটে যাওয়ার পর সেটে ফিরলাম।… কাজে ফিরতে পেরে ভাল লাগছে। ফিরতে পেরে কেমন লাগছে সেটা বলে বোঝাতে পারব না। কাজেই তো ফিরতে চেয়েছিলাম ‘
এমনকি কোমরের নীচে জল ভরা একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে বিভিন্ন ব্যায়াম করার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন সোনালি। কষ্টকর এই অ্যাকোয়া থেরাপি নিয়েও কিছুই লুকোননি। এই সময় পরিবারের সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্তও ভাগ করেছেন ভক্তদের সঙ্গে। নিজেই বার বার তাঁদের সাহস জুগিয়েছেন। নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে ভয় পেতে বারণ করেছেন।
সময় মতো চিকিৎসার পাশাপাশি সোনালির এমন মনের জোর ও সাহসই তাঁকে এই বড় যুদ্ধ জয় করতে সাহায্য করেছেন বলে মনে করেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সোমনাথ সরকার। ফের টিভি ও রুপোলি পর্দায় দাপিয়ে ফিরে আসুন সোনালি এমনই আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভক্তকুলের। অন্য দিকে ক্যানসার রোগীরাও তাঁর ফিরে আসাকে ইনিংস হিসেবে দেখে নিচ্ছেন সাহস ও মনের জোরের পাঠ।
এমএস/এসি