ইউক্যালিপটাস গাছ নিয়ে উত্তরবঙ্গে উদ্বেগ বাড়ছে
প্রকাশিত : ২০:৩৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২০:৩৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
ধান ক্ষেতের মাঝে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি- সংগৃহীত
জাতীয় সংসদের কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাস গাছের জায়গায় কাঁঠাল, জাম, নিম বা এ ধরণের গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু ইউক্যালিপটাসের রোপণ নিষিদ্ধ করার পরেও গাছটির বিস্তার সেখানে বাড়ছে। খবর বিবিসি’র।
ঐ কমিটির সদস্য ও গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি জানান, সরকারের মুজিববর্ষ পালনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলছে। তিনি বলেন, ‘এ আলোচনার সময় কৃষিমন্ত্রী নিজেই ইউক্যালিপটাস গাছ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরেন। জনস্বার্থে ও পরিবেশ বিবেচনায় ক্ষতিকর গাছের জায়গায় ফলজ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষ রোপণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানান। তখন সদস্যরা সবাই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।’
তিনি বলেন, তবে গাছ অপসারণ নিয়ে কোনো ইস্যু যাাতে তৈরি না হয় সেজন্য মানুষকে সম্পৃক্ত করে এসব কর্মসূচির পরামর্শ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়কে।
পরে সংসদীয় কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে কাঁঠাল, জাম ও নিম গাছ রোপণের সুপারিশ করা হয়েছে।
উত্তরবঙ্গে এতো ইউক্যালিপটাস কীভাবে এলো:
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাসের সংখ্যা কত বা এগুলোর প্রভাবে কী হচ্ছে তার কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা সরকারের বন বিভাগ বা পরিবেশ বিভাগ বলতে পারেনি। তবে দুই বিভাগই স্বীকার করছে, উত্তরাঞ্চলে এই গাছ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান এবং এর কারণ হলো এক সময় সরকারি কর্মসূচি বিশেষ করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতাতেই ইউক্যালিপটাস গাছ ঐ অঞ্চলে রোপণ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত আশির দশকে সরকারিভাবে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও পাইনের মতো বিদেশী গাছগুলো বাংলাদেশে আনা হয় এবং বিনামূল্যে বিতরণও করা হয় নানা প্রজেক্টের আওতায়। পরে ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এবং এরপর বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে।
রংপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র জানান, আগে থেকেই ঐ এলাকায় ইউক্যালিপটাসের প্রাধান্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন বনবিভাগ এ গাছটি রোপণ করে না। বরং নিষিদ্ধ করেছি আমরা। কিন্তু অনেক আগে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে প্রতি কিলোমিটারে এক হাজার চারা রোপণ করা হয়েছিল এবং প্রতি কিলোমিটারে সুবিধাভোগী ছিল ৫ জন। এদের জন্য দ্রুত অর্থনৈতিক লাভ আসে এমন গাছের চিন্তা থেকে তখন এটা করা হয়েছিলো।’
তিনি বলেন, ‘পরে বিষয়টি ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হয় এবং পুরো অঞ্চল-জুড়ে বহু মানুষ নিজের জমিতেও ইউক্যালিপটাস রোপণ করেন। নীলফামারীতে তিস্তার অববাহিকা বালুময় এলাকা। আবার ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে এ গাছের কাঠের চাহিদা অনেক। ফলে ব্যক্তি উদ্যোগে যারা এটি রোপণ করেছেন তারা দেখেছেন ১০/১২ বছরে ভালো লাভ পাওয়া যাচ্ছে। এটিও এর বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।’
ক্ষতির পরিমাণ:
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন চৌধুরী বলছেন, বিষয়টি নিয়ে গবেষণার দরকার এবং তারা এসব বিষয়ে কাজ করতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘তেমন কোন গবেষণা না থাকায় গাছটির বিস্তারিত ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তথ্য নেই। তবে এটি যে আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তা নিয়ে সন্দেহ নেই।’
ফলজ গাছ রোপণের পক্ষে ক্যাম্পেইন করে এমন একটি সংগঠন ফলদ বাংলাদেশ’র সংগঠক সঞ্জয় ঘোষ জানান, বৈজ্ঞানিক কোন গবেষণা ইউক্যালিপটাসের প্রভাব নিয়ে হয়নি। তিনি বলেন, ‘বরং উত্তরবঙ্গে অনেকে ইউক্যালিপটাসের বাগান করেছেন। তারা মনে করেন দ্রুত লাভের জন্য এটা ভালো। আমরা তাদের বুঝিয়েছি যে এর চেয়ে ফলজ গাছে লাভ বেশি। অনেকে তাতে উদ্বুদ্ধও হয়েছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইউক্যালিপটাস বন্ধের কথা বললেও উত্তরবঙ্গে আপনি দেখবেন নার্সারিগুলোতে হরদম এটি বিক্রি হচ্ছে এবং ফলজ গাছের চেয়ে কম দামে।’
তিনি আরও বলেন, ক্ষতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক গবেষণা না হলেও পরিবেশ নিয়ে যারা জ্ঞান রাখেন তারা জানেন ইউক্যালিপটাস গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। তাছাড়া এক অঞ্চলের গাছ অন্য অঞ্চলে হলে জৈব বৈচিত্রের জন্য তা ভালো হয় না।
সঞ্জয় ঘোষ বলছেন, এই গাছের পাতায় পেট্রলিয়াম জাতীয় পদার্থ আছো। অথচ আপনি দেখবেন উত্তরবঙ্গে এমনভাবে হয়েছে কৃষি জমির মাঝ বরাবর প্রচুর ইউক্যালিপটাস গাছ।
সেখানকার মানুষ যুক্তি দেয় যে, ‘গাছটিতে বেশি যত্ন লাগে না আর ছাগলেও খায় না। কিন্তু এর ভয়ংকর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের কেউ ঠিকভাবে অবহিত করে না।’
রংপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র জানান, বন বিভাগের রিসার্চ সেন্টার থেকে যে তথ্য আসছে তা হলো বাংলাদেশে যেহেতু ব্যাপক বৃষ্টি হয় তাই মরুময়তা ওভাবে চোখে পড়ে না। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে ইউক্যালিপটাসের কারণে মরুময়তা সৃষ্টি হয়। তবে আরও গবেষণা দরকার। আমরা বন বিভাগ থেকে আগেই এটি বন্ধ করেছি সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতে।’
তার মতে ইউক্যালিপটাসের ব্যাপক উপস্থিতি ও বিস্তারের প্রবণতার মধ্যেও উত্তরাঞ্চলে শস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং একই সঙ্গে আম, লিচুর মতো ফলের উৎপাদনও ব্যাপক বেড়েছে। তবে রংপুরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর মেজবাউল আলম বলছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সব সময়ই এ গাছটির বিরোধিতা করছে।
তিনি বলেন, ‘লোকাল ভ্যারাইটিকে ক্ষতির মুখে ফেলে এ গাছটি। তাই আমরা সব সময় এর বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নার্সারিতে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। এটি আমাদের ইকো সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর।’
তবে যেহেতু কোনো আইন নেই বা বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি তাই এর বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই বলে জানান তিনি।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে কাঁঠাল, জাম ও নিম গাছ রোপণের সুপারিশ করা হলেও তারা তাদের এলাকায় গাছটির প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোন গবেষণা করেনি। এমনটি জানান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন চৌধুরী। অনেক কৃষককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ইউক্যালিপটাস তারা কেন বপন করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কৃষকরা জবাবে বলেছেন, গাছটি আমরা চিনতাম না। সরকারের লোকজনই চিনিয়েছে। আর দ্রুত কাঠ হিসেবে বিক্রি করা যায় এবং বিক্রয়মূল্য ভাল। তাদের দাবি কাঠের মানও ভাল। ফলে আয় হয় ভাল।’
তিনি বলেন, ‘কোন গবেষণা না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলেন, গাছটিতে প্রচুর পানির দরকার হয়। এমনতেই বরেন্দ্র এলাকায় বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন দরকার হয় সেচের জন্য, তার মধ্যে আবার এই বিপুল সংখ্যক গাছ প্রতিনিয়ত পানি শোষণ করছে।
তিনি জানান, কিছু লাভ হলেও এটি আসলে ক্ষতিকর। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সমস্যা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন এ গাছটি কীভাবে কমানো যায়। মানুষকে উৎসাহিত করবো ফলজ বা বনজ উদ্ভিদের দিকে আগ্রহী করে তুলতে, কারণ তাতে আরও বেশি লাভ হবে তাদের।
এমএস/