বিলুপ্তির পথে জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প (ভিডিও)
প্রকাশিত : ১৮:৫১, ৩ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৮:৫৫, ৪ জানুয়ারি ২০২৩
কাঁসা তৈরির টুং টাং শব্দ আর ক্রেতাদের পদচারণায় একসময় মুখরিত থাকতো জামালপুর জেলার ইসলামপুরের কাঁসারীপাড়া। ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও সমাদৃত হয়েছিল। তবে সেই চিত্র এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
আজ থেকে দুই যুগ আগেও কোনো বিয়ে-সাদি, আকিকাসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো কাঁসার জিনিসপত্র। নানা কারণে ক্রমেই কাঁসার জিনিসপত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সারাদেশে থেকে ব্যবসায়ীরা কাঁসা সামগ্রী কিনতে ভিড় জমাতো ইসলামপুরে। কারখানাগুলোতে কারিগররা দিনরাত কাজ করেও কাঁসা সামগ্রী সরবরাহে হিমশিম খেতো।
জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম নামক শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রদর্শীতে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের প্রয়াত কাঁসা-শিল্পী স্বর্গীয় জগৎচন্দ্র কর্মকার কারুকার্যপূর্ণ কাঁসা শিল্পটির প্রদর্শন করেন। ওই প্রদর্শনীতে ইসলামাপুরের কাঁসা শিল্প সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ব বিখ্যাত শিল্প হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল। তারপর থেকে সারা বিশ্বে কাঁসা শিল্পের পরিচিতি লাভ করে। সে সময় দিনে দিনে কাঁসার শিল্পের আরও চাহিদা বেড়ে যায়। কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
বাংলার এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন কোথায় কিভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে সুনিদিষ্ট কোনো উল্লেখ না থাকলেও অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিল্প গবেষণা নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে এটা একটি প্রাচীন আমলের সভ্যতা। ওই আমলেও ব্রোঞ্জ শিল্প ছিল। আবার কেউ কেউ পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ততাও করতে চান। আবার অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীরা এই শিল্পটিকে রামায়ন মহাভারতের যুগের বলে মনে করেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতবর্ষে পূর্ববাংলার ঢাকার ধামরাই এলাকায় কাঁসার শিল্পী এসে বসতি স্থাপন করে কারখানা গড়ে তোলেন। পরবর্তী কালক্রমে বিভিন্ন কারণে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। কাঁসা শিল্পীরা তাদের লাভজনক পেশা হওয়ার পেশাগত শিল্পজীবন পারিবারিকভাবে গড়ে তোলার কারণে একই পাড়া-মহল্লায় বসবাস করতেন। তাই তাদের বসবাসকারী এলাকাকে কাঁসারি পাড়া নামে পরিচিতি লাভ করে ছিল।
ভারতবর্ষে কাঁসা দিয়ে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে ব্যবহার করে আসছিল বলে সে সময় জটিল কোন রোগবালাই ছিল না। বর্তমানে টিন, অ্যানুমিনিয়ামের ব্যবহারে নতুন নতুন রোগের আবিভার্ব ঘটেছে বলে দাবি করছেন কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
তারা জানান, বর্তমানে তামার দাম অত্যাধিক বাড়ায় টিন ও সিসার মূল্য দুইশ টাকার স্থানে সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা কেজি ধরে ক্রয় করায় তৈরি খরচ অত্যাধিক বেশি হয়ে যায়। কেননা বিশ্বের একমাত্র টিন ও সিসা মালয়েশিয়া ব্যতিত অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায় না। তাই সরকারিভাবে আমদানি না থাকায় ২শ’ টাকার কেজি টিন বর্তমানে বাজারে সাড়ে ৪ হাজার টাকা কেজি ক্রয় করতে হয়। এ কারণে আট গ্রাম তামা, ১ হাজার ২শত গ্রাম টিন ও সিসা প্রায় ৮শত টাকা এবং কারিগর খরচ পড়ে তাদের ৫শত টাকা। তাই এক কেজি কাঁসা তৈরি খচর পড়ে ১ হাজার ৮শত টাকা এবং কারিগর মজুরি ৫শত টাকা, সর্বমোট ২ হাজার ৩শত টাকা খরচ হয়ে থাকে। বিক্রয় করতে হয় ২ হাজার ৫শত টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায়। এ কারণে ক্রেতারা উচ্চমূল্যে যেমন খরিদ করতে চায় না, তেমনি করে কারিগর ও শিল্পীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের বর্তমানে দুর্দিন চলছে। অনেকেই বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ শিল্পটি ঢাকাই মসলিনের মতো বিলীন হয়ে যাবে।
নানা সংকটেও ৬টি প্রতিষ্ঠান ইসলামপুরের কাঁসা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের সমাজসেবা দপ্তরসহ অন্যান্য দপ্তরে প্রশিক্ষনসহ প্রণোদনা দিয়ে সহায়তার কথা জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান রুমান।
ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখার স্বার্থে কাঁসারীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ আর শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানীর সুযোগ করে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
এমএম/