এলিয়েন খুঁজে পাওয়া ‘সময়ের ব্যাপার মাত্র’ কেন বলছেন বিজ্ঞানীরা?
প্রকাশিত : ১৬:৩০, ১ অক্টোবর ২০২৩
মহাবিশ্বে অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা, অনেক বিজ্ঞানী এখন আর সে প্রশ্ন করেন না। বরং তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, কবে সেই প্রাণের খোঁজ মিলবে? বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ আশাবাদী যে, আমাদের জীবদ্দশায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ত দূরের কোন গ্রহে জীবনের সন্ধান পাওয়া যাবে।
বৃহস্পতি গ্রহে মিশন পরিচালনা করছেন, এমন একজন বিজ্ঞানী আরও একধাপ এগিয়ে বলছেন, বরফে ঢাকা এই গ্রহে কোন প্রাণ না থাকলে সেটাও হবে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার।
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সম্প্রতি সৌরজগতের বাইরের একটি গ্রহে জীবন থাকা সম্পর্কে ইঙ্গিত শনাক্ত করেছে। সেখানে পৃথিবীর মতো আরও অনেক গ্রহ রয়েছে বলে নাসা ধারণা করছে।
পৃথিবীর বাইরে প্রাণের খোঁজ পাওয়া হবে সর্বকালের সর্ববৃহৎ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। সেজন্য এর মধ্যেই বেশ কিছু মিশন শুরু হয়েছে বা শুরু হতে যাচ্ছে।
স্কটল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্যাথরিন থেইম্যানস বলেন, "অসীম নক্ষত্র এবং গ্রহের একটি মহাবিশ্বে আমরা বসবাস করি। সেখানে অবশ্যই আমরাই শুধু একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হতে পারি না।"
"এই মহাবিশ্বে আমরাই একা আছি কিনা, সে প্রশ্নে উত্তর খোঁজার মতো প্রযুক্তি এবং ক্ষমতা এখন আমাদের আছে," তিনি বলেন।
‘গোল্ডিলক্স জোন’
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে যে টেলিস্কোপগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এখন দূরের নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণকারী গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করতে পারে। পৃথিবীর মতো জীবিত প্রাণী দ্বারা উৎপাদিত হয়, এমন রাসায়নিকের সন্ধান করতে পারে।
এ মাসের শুরুর দিকে সেখানে বড় ধরনের একটি আবিষ্কার হয়, ১২০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কে২-১৮বি নামের একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এমন গ্যাস শনাক্ত করা হয়, যা পৃথিবীতে সামুদ্রিক জীব দ্বারা উৎপাদন হয়ে থাকে।
এই গ্রহটিকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন ‘গোল্ডিলক্স জোন’ নামে।
যে নক্ষত্রকে ঘিরে ওই গ্রহ ঘুরছে, তার থেকে এমন দূরত্বে সেটি রয়েছে, যাতে সেটির ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠাণ্ডা হয় না।
সেখানে তরল পানি থাকার জন্যও সঠিক তাপমাত্রা রয়েছে, যা জীবন থাকার জন্য অপরিহার্য।
বিজ্ঞানীদের একটি বিশেষজ্ঞ দল আশা করছে, আগামী এক বছরের মধ্যেই তারা জানতে পারবেন যে, আগ্রহ উদ্দীপক এসব ইঙ্গিত সেখানে আসলেই জীবন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করছে কিনা।
যিনি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক নিক্স মধুসূদন বিবিসিকে বলেছেন, এসব ইঙ্গিত যদি সত্যি বলে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তা ‘জীবনের সন্ধান সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে আমূল বদলে দেবে।‘
"যদি আমরা এই গ্রহে জীবনের চিহ্ন খুঁজে পাই, তাহলে এই সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে যে, মহাবিশ্বে এরকম আরও জীবন থাকতে পারে।"
তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, পাঁচ বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের জীবন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার 'একটি বড় পরিবর্তন' হবে।
কিন্তু যদি এই গ্রহের জীবনের খোঁজ পাওয়া না যায়, তাহলে বিজ্ঞানীদের এই দলের তালিকায় আরও ১০টি গোল্ডিলক্স গ্রহ রয়েছে, যেগুলো নিয়ে তারা গবেষণা করবেন।
এরপরেও আরও কিছু গ্রহের তালিকা রয়েছে তাদের কাছে।
মহাবিশ্বে জীবনের সন্ধানে যেসব গবেষণা চলছে, তার এই প্রকল্প সেগুলোর মধ্যে একটি মাত্র।
অন্য প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলোয় প্রাণের সন্ধান করছে। আবার কিছু প্রকল্পে নজর দেয়া হচ্ছে মহাকাশের আরও গভীরে।
নাসা ২০৩০ সাল নাগাদ ‘হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবজারভেটরি (এইচডব্লিউও) বা বাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে বের করার একটি অনুসন্ধান কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা করছে।
সেখানে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর মতো গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল চিহ্নিত করতে এবং পর্যালোচনা করতে সক্ষম হবে।
এই দশকের শেষের দিকে আসছে বিশাল বড় টেলিস্কোপ (এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ-ইএলটি)।
চিলির মরুভূমি থেকে সেটা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
অন্য টেলিস্কোপগুলোর তুলনায় সেটিতে বড় আকারের আয়না থাকবে, ফলে সেটি গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল আরও ভালোভাবে দেখতে পারবে।
এগুলো এতই অবিশ্বাস্য শক্তিশালী যে, শত শত আলোকবর্ষ দূরের একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণকারী একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে আলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ শনাক্ত করতে পারে।
সৌরজগতে কি প্রাণ আছে?
যখন অনেক বিজ্ঞানী দূরের গ্রহগুলোয় প্রাণ খুঁজছেন, তখন বিজ্ঞানীদের আরেকটি দল জীবন খুঁজছে সৌরজগতের গ্রহগুলোয়।
জীবনের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি জায়গা হতে পারে বৃহস্পতির বরফে ঢাকা চাঁদ, ইউরোপা।
এটি একটি সুন্দর উপগ্রহ যার পৃষ্ঠে ফাটল রয়েছে যা দেখতে অনেকটা বাঘের ডোরাকাটার মতো।
ইউরোপার বরফের পৃষ্ঠের নীচে একটি মহাসাগর রয়েছে, যেখান থেকে জলীয় বাষ্পের বরফ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
নাসার ক্লিপার এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএর জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার (জুস) মিশন উভয়ই ২০৩০ এর দশকের প্রথম দিকে সেখানে পৌঁছাবে।
শনির একটি চাঁদে অবতরণ করার জন্য ড্রাগনফ্লাই নামে একটি মহাকাশযানও পাঠাচ্ছে নাসা।
সেখানে কার্বন-সমৃদ্ধ রাসায়নিক পদার্থ থেকে তৈরি হ্রদ এবং মেঘ রয়েছে, যা উপগ্রহটিকে একটি কমলা রঙের কুয়াশার আবরণ তৈরি করেছে।
পানির পাশাপাশি এসব রাসায়নিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান বলে ধারণা করা হয়।
মঙ্গল গ্রহে জীবিত প্রাণী নেই বলেই এখন মনে করা হচ্ছে।
তবে জ্যোতির্জীববিদরা মনে করেন, এই গ্রহের একসময় ঘন বায়ুমণ্ডল এবং মহাসাগর ছিল, যা জীবন ধারণের জন্য সহায়তা করে।
বর্তমানে সেখানে নাসার রোভার যান একটি গর্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে, যা একসময় একটি প্রাচীন নদীর ব-দ্বীপ ছিল।
এরপর ২০৩০ সালের দিকে এসব নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসার পর সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আরও পরিষ্কার ধারণা পাবেন।
ভিনগ্রহের প্রাণীরা কি আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে?
অনেক বিজ্ঞানী এই ধারণাকে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বলে মনে করলেও ভিনগ্রহ থেকে রেডিও সিগন্যাল আসছে কিনা, তা নিয়ে বহু বছর ধরেই গবেষণা চলছে।
সার্চ ফর এক্সটা টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Seti) ছাড়াও আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই গবেষণা করছে।
যদিও বিশাল মহাবিশ্ব জুড়ে এলোমেলোভাবে চালানো এসব অনুসন্ধানে এখনো কোন সম্মিলিত ফলাফল আসেনি, কিন্তু অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত হলে তারা তখন সেদিকে অনুসন্ধানের জন্য গুরুত্ব দিতে পারবে।
ত্রিশ বছর আগেও অন্য নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরছে, এমন কোন গ্রহ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কাছে প্রমাণ ছিল না।
কিন্তু এখন এরকম পাঁচ হাজারের বেশি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা নিয়ে গবেষণা করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
কেট২-১৮বি গবেষণা দলের একজন সদস্য কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির শুভজিৎ সরকার মনে করেন, সমস্ত উপাদানগুলো একটি আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।
"যদি আমরা জীবনের লক্ষণ খুঁজে পাই, তাহলে সেটি বিজ্ঞানের জন্য বিশাল এক বিপ্লব হবে। তার ফলে মানবজাতির নিজের এবং মহাবিশ্বে তার অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশাল একটি পরিবর্তন এনে দেবে," তিনি বলেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/