খাদ্য সংকটে ভাসমান কুকুরগুলো
প্রকাশিত : ১৬:৪৫, ৯ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৭:০৫, ৯ এপ্রিল ২০২০
খাবারের খোঁজে কুকুরগুলো
মরনঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ব্যস্ত রাজধানীর সড়ক এখন জনশূন্য। হোটেল, রেস্তোরাঁসহ খাবারের ও মাংসের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় খাবার সংকটে পড়েছে নগরীর ভসমান কুকুরগুলো। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে নানা আলোচনা। তাই অবরুদ্ধ নগরীতে ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোকে খাবার দিয়ে পাশে দাঁড়নোর আহ্বান জানিয়েছে প্রাণীপ্রেমীরা।
সাধারণ মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে যে প্রাণীগুলো এতদিন ক্ষুধা মেটাতো, এখন তাও বন্ধ। এ পশুগুলোর দিকে নজর নেই কারো, এতে করে অভুক্তই থাকছে কুকুরগুলো। সারা দেশ যখন লকডাউন তখন খাদ্য সংকটে পড়া অফিসপাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে নিজ উদ্যোগে খাবার দিচ্ছেন কেউ কেউ।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর রাস্তা-ঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ায় বেওয়ারিশ কুকুরগুলো আশপাশে ছুটাছুটি করেও পাচ্ছে না খাবার। অভুক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে কিংবা কোনো বন্ধ দোকানের সামনে কিছু খাবারের আশায় ঘুমিয়ে আছে।
এছাড়াও রাজধানীর প্রায় অর্ধেক মানুষ গ্রামে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন রাস্তা ও মহল্লার ডাস্টবিনগুলোতে তেমন উচ্ছিষ্ট খাবার পড়ে থাকছে না। এতে করে খাবারের মহাসংকটে পড়েছে এসব বেওয়ারিশ কুকুরগুলো।
তবে পশুপ্রেমীরা বলেছেন, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। সংকটময় এই মুহূর্তে অভুক্ত প্রাণীগুলোকে নিজের খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট দেয়া দরকার। অন্তত সারাদিনে এক-দুবার কিছু খাবার পেলেও বেঁচে যাবে কুকুরগুলো।
এই সংকটময় মুহূর্তে বেওয়ারিশ কুকুরদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার বলেন, বর্তমানে কুকুরদের নিয়ে সিটি কর্পোরেশন কিছু করছে না।
তিনি বলেন, সমাজের পশুপ্রেমী ভলান্টিয়ার যারা আছেন এ মুহূর্তে তাদের এগিয়ে আসা দরকার। এখন বাসাবাড়ি থেকে কেউ বেরুতে পারছেন না। আবার ঢাকা সিটি থেকে প্রায় দেড় কোটি লোক গ্রামে চলে গেছে। ফলে উচ্ছিষ্ট খাবারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, পশুগুলো খাবার সংকটে আছে। তাজিনা সরোয়ার আরও বলেন, আমরা সবাই যে যার দিক থেকে সেলফ প্রোটেকশন নিয়ে কুকুরগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি।
সিফাত রানা নামের রাজধানীর একজন পশুপ্রেমী বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সমস্ত পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়েছে। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মানুষের ও পশু-পাখির ভারসাম্য জরুরি। তিনি বলেন, সবকিছু বন্ধ থাকায় এখন কুকুরদের খাদ্যের জোগানও বন্ধ হয়ে গেছে। ওরা তো নিজেরা একা খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারে না। তাই ওদের খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার। মানবিক হিসেবে এটি আমাদের দায়িত্ব। সিফাত এ সময় সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বেশকিছু আশার খবর দেখা গেছে গত কয়েকদিনে। করোনার এ সংকটময় দিনগুলোতে খাদ্য সংকটে থাকা রাস্তার অভুক্ত কুকুরদের খাওয়াতে দেখা গেছে তারকা অভিনেত্রী জয়া আহসানকে।
করোনা সংকটের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে প্রায় ৩০টি কুকুরকে নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন রাজধানীর ইস্কাটন এলাকার এ বাসিন্দা। অভিনয়ের বাইরে পশুপ্রেমী হিসেবেও পরিচিত এ অভিনেত্রী নিজেও একটি কুকুর পোষেণ।চলমান সংকটকালে নিজের কুকুরকে দেখভালের পাশাপাশি ঢাকার জনশূন্য রাস্তায় অভুক্ত থাকা কুকুরগুলোর জন্য মুরগির মাংসের সঙ্গে বিশুদ্ধ খাবার পানির বন্দোবস্তও করেন তিনি।
যার বেশ কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন জয়ার ভাই অদিত মাসউদ। খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা বেওয়ারিশ কুকুরসহ অন্য প্রাণীদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন অদিত।
এছাড়াও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচিতে দিনভর ব্যস্ত থাকার পর রাতে ক্ষুধার্ত কুকুরদের খাবার দিয়েছেন পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিরোজপুর ইউথ সোসাইটির তরুণদের নিয়ে পৌর এলাকার বিভিন্ন সড়কে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত কুকুরদের নিজ হাতেই খাবার দেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা দেশের মতো পিরোজপুরও সাধারণ ছুটিতে। শহরের হোটেল ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় কুকুরদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাই স্থানীয় এ তরুণদের সাথে নিয়ে পৌর এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় থাকা ক্ষুধার্ত কুকুরদের খাবার দেয়া হয়েছে।
অভুক্ত কুকুরদের খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের এমন উদ্যোগের ছবি ইতোমধ্যে সোস্যাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটিকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন অনেকে।
এদিকে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কুকুর ও বিড়ালসহ অভুক্ত প্রাণীদের খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নির্দেশে গত রোববার বিকেলে নগরীর সাহেববাজার বড় মসজিদের সামনে থেকে কুকুরকে খাবার খাওয়ানো শুরু হয়।
এরপর মহানগরীর সাগরপাড়া, বেলদারপাড়া, দোসরমণ্ডলের মোড়, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন, ভদ্রা, তালাইমারি, সাধুর মোড়, মোন্নাফের মোড়, কাজলাসহ অন্যান্য এলাকায় পাউরুটি এবং বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট ও কেক খাওয়ানোর খবর ও চিত্র পাওয়া যায়।
ঢাকা, রাজশাহী, পিরোজপুরের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও অসংখ্য উদ্যোগের চিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জয়ার মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনেক জায়গায়। চলমান এই সংকট মোকাবেলায় এরকম ব্যক্তিগত ও যৌথ উদ্যোগে অভুক্ত সকল মানুষ ও পশু-পাখির প্রতি মানবিক দায়ীত্ব পালন সময়ের দাবি।
এনএস/