ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

জেগে উঠুন নতুন উদ্যমে

পথচারী

প্রকাশিত : ১৯:০৯, ২৩ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ২১:০৮, ২৩ আগস্ট ২০২১

Ekushey Television Ltd.

মহামারিকাল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোস্ট-কোভিড ট্রমা বা কোভিড পরবর্তী মনোদৈহিক বিপর্যয়, যা ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তরণের উপায় হিসেবে চিকিৎসাবিদ, মনোবিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিটেশন, প্রাণায়াম, ইয়োগা এবং সমমর্মী জীবনদৃষ্টি ও পারস্পরিক একাত্মতার মধ্যেই নিহিত এর কার্যকর সমাধান। 

এ বছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় ব্যতিক্রমী এক কনসার্টের আয়োজন করা হয়। স্টেজে ব্যান্ডদল এবং গ্যালারিতে দর্শকবৃন্দ—সবার জন্যে ছিল একটি করে বিশাল প্লাস্টিক বাবল। এর উদ্দেশ্য, করোনাভাইরাস যেন না ছড়ায়। কনসার্টের পুরো সময় তারা একেকটা স্বচ্ছ বাবলের মধ্যেই অবস্থান করেন। এর ভেতরে ছিল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, এক বোতল পানি, তোয়ালে এবং ব্যাটারি চালিত ছোট্ট একটি ফ্যান।(বিবিসি, ২৫ জানুয়ারি ২০২১)

এ দৃশ্য যতই অবাস্তব মনে হোক, কোভিডের ভয়-আতঙ্ক ও তথাকথিত আধুনিকতা চারপাশে বহু মানুষকে অদৃশ্য একেকটা বাবলের ভেতরেই যেন বন্দি করে রেখেছে। আর তার সঙ্গী হয়েছে রোগভয় ও ডিজিটাল স্ক্রিন আসক্তি। 
মনো চিকিৎসকেরা বলেছেন বৃত্তটা ভাঙুন, আপনজনের কাছে যান। সব জড়তা ভেঙে পরিবার-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের কাছে যান। দেখা করুন, মন খুলে কথা বলুন। আপনজনদের সান্নিধ্য মন ভালো করে দেয়ার পাশাপাশি আপনার সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে অনেকগুণ। স্বেচ্ছাসেবায় যুক্ত হোন। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্যে কাজ করুন। এতে বাড়বে আপনার পরিচিত বলয় এবং কমবে অপ্রয়োজনীয় দুঃখবোধ। সবকিছুর আগে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি যত্মশীল হোন, সতর্ক হোন।

বাইরে থেকে কেউ এসে সব বদলে দেবে—এই অলীক প্রত্যাশায় কিছু বদলায় না। কারণ সমাধানের সহজ সূত্রটি হলো, দায়িত্বটা নিজেকে নিতে হবে। একাকিত্ব দূর করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী হতে হবে নিজেকেই। 

সম্প্রতি ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১৩-২৯ বছর বয়সী কিশোর-যুবাদের ওপর ইউনিসেফের একটি জরিপে দেখা যায় যে, কোভিড-১৯ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

এর মধ্যে উদ্বেগ, বিষন্নতা, কাজে মনোযোগহীনতা বা আগ্রহ বোধ না করা, হতাশা, স্ট্রেস অনুভব করা ইত্যাদি প্রধান। আমাদের শিশু-কিশোররা কীভাবে তাদের সময়কে উপভোগ্য করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজন আমাদের বিশেষ সচেতনতা।

কর্মব্যস্ত চেনা দিনগুলোতে বড় রকমের একটা ছন্দপতন শুরু হলো ২০২০ সালে। সারা বিশ্বজুড়েই। প্রায় দেড় বছরের এই করোনাকালে জনজীবনের কোথায় কোথায় বদল এসেছে, সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ এবং প্রায় সবারই জানা। তবে যে পরিবর্তনটি সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে—তা হলো আতঙ্ক, জড়তা ও মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা।

যে-কোনো প্রতিকূলতা, দুর্যোগ বা লড়াইয়ের দুটো পর্যায় থাকে। প্রথমটি হলো প্রত্যক্ষ পর্যায়, যেটা দৃশ্যমান। আরেকটি পর্যায় হলো অদৃশ্য, যার প্রভাব পড়ে মানুষের অন্তর্জগতে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দ্বিতীয় এই পর্যায়টি যে জাতি বা যে সমাজ সফলভাবে মোকাবেলা করেছে, তারাই এগিয়ে যেতে পেরেছে, সফল হয়েছে।

যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয় না কিন্তু এর প্রভাব বহুদিন থাকে। যুদ্ধ কোনো জাতিকে ধ্বংস করে দেয়, আবার ধ্বংসস্তূপ থেকে কোনো জাতি নতুনভাবে জেগে ওঠে। সবটাই নির্ভর করে জাতিগত সামর্থ্য, সঠিক সিদ্ধান্ত, সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও সঙ্ঘবদ্ধতার ওপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূলতা, মহামারির ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য।

আমাদের দেশের মানুষ করোনাকালের প্রথম পর্যায়টি পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় সফলভাবে মোকাবেলা করেছে। এখন প্রস্তুতি প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্যে। ঘরবন্দি থাকার কারণে বহু মানুষ আজ ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত, বেড়েছে তাদের বিষন্নতা অসহিষ্ণুতা অবসাদ এমনকি আত্মহত্যা-প্রবণতাও। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা।

জড়তা ও আতঙ্কের এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—ভালো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হোন। এই ভালো হতে পারে কোনো সেবামূলক কাজ বা ইতিবাচক মানুষের কোনো সঙ্ঘ। অর্থাৎ যেখানে অনেক মানুষের সংস্পর্শ থাকবে এবং থাকবে বিশ্বাস ও আশা।

যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ো ক্লিনিকের মতে, কোভিড পরবর্তী সময়ে কারো কারো মাঝে যে উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে, তা হলো অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, কফ, শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনা, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ হ্রাস, ঘুমের সমস্যা, বিষন্নতা, ঝিমুনি, ক্লান্তি ইত্যাদি। এ তালিকার অধিকাংশ রোগই মনোদৈহিক অর্থাৎ রোগের প্রভাব দেহে প্রকাশ পাচ্ছে বটে, কিন্তু উৎস হলো মন।

এ ধরনের রোগগুলোর জন্যে ওষুধ বা প্রচলিত চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন মনের শুশ্রূষা। এ লক্ষ্যে পৃথিবীজুড়ে কার্যকরী যে পথটি বাতলে দিচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা, তা হলো মেডিটেশন প্রানায়ম, যোগ ব্যায়াম।
আপনার নিজের পরিবার অফিস বা বন্ধুরা মিলে মেডিটেশন, প্রাণায়াম চর্চাশুরু করতে পারেন। আপনার এই একটি উদ্যোগ শুধু যে ব্যক্তিজীবন থেকে জড়তা-আতঙ্ক-হতাশা ভাসিয়ে নেবে তা নয়, ব্যক্তি থেকে তা রূপ নেবে সমষ্টির আত্মবিশ্বাসে। স্থবিরতার শেকল ভেঙে সূচিত হবে জাতিগত উত্থান।

নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় এ-কালের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক স্টিভেন লরিস যিনি বর্তমানে বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লিজ-এ একটি গবেষক দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দুই দশক ধরে তিনি কাজ করেছেন মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে। গবেষণা করেছেন মন ও মস্তিষ্কের ওপর মেডিটেশনের ইতিবাচক প্রভাব নিয়েও। ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার বই দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন : অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন।

৩ এপ্রিল ২০২১ যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রেনকে রি-টিউন করার পাশাপাশি মহামারির সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায় আরো উঠে এসেছে রোগ নিরাময়, অস্থিরতা ও স্ট্রেসমুক্তি, শিশু মনের বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রে মেডিটেশনের উপযোগিতার বিষয়টি। 

মেডিটেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর চর্চা ব্রেনকে রি-টিউন করে। সহজ ভাষায় মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম। যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তার পায়ের পেশি মজবুত হয়; আবার যখন কেউ সাঁতার কাটে, তার হাতের পেশির শক্তি বাড়ে।  তেমনি আমরা যখন মেডিটেশন করি, মস্তিষ্কের ভেতরেও আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন।

নিজেকে ভালবাসতে শিখুন। দেহ-মনের যত্ন নিন, সুস্থতার প্রতি মনোযোগী হোন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যের জীবনের ফিল্টারিং অংশ দেখে বা মতামতের মুখাপেক্ষী হলে আপনি কখনো নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন না। প্রশান্তিতে থাকতে পারবেন না। পাছে লোকের কিছু কথা শোনা থেকে যত বিরত থাকবেন, আপনি তত সফল হবেন।

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি