ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

যে কারণে সময়ের আগেভাগে এত বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৩৯, ১ এপ্রিল ২০২২

বাংলাদেশে প্রতি বছরই গরমকালে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এই বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে এবং মার্চের মাঝামাঝি থেকে বেশ ব্যাপকহারে তা বাড়তে শুরু করেছে।

সাধারণত প্রতি বছর এর প্রকোপ শুরু হয় এপ্রিলের শুরু থেকে এবং ছয় থেকে আট সপ্তাহ তা চলতে থাকে। কিন্তু এই বছর ডায়রিয়া যে শুধু আগেভাগেই শুরু হয়েছে তাই নয়, রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে অনেক বেশি।

এই সপ্তাহের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

রোগীর চাপ কেমন
ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরু হলেই যে সংগঠনটির নাম সবসময় সাধারণ মানুষজন এবং গণমাধ্যম বারবার উল্লেখ করে সেটি হল স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর, বি।

এক সময় শুধু কলেরা নিয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী এই প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম জানিয়েছেন মার্চের ছয় তারিখ থেকে তারা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা খেয়াল করেছেন।

তবে ২৮ তারিখ থেকে সেখানে রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল গড়ে প্রতিদিনই তেরশ'র বেশি এবং রোগীর হার একই রকম রয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, "এই মাসের ২২ তারিখ এক দিনে বারোশ বাহাত্তর জন রোগী ভর্তি হয়েছে - যা আমাদের জন্য বেশ বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। কারণ এখানে কখনোই একদিনে এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়নি। গত কয়েকদিন ধরেই প্রতিদিন তেরশ'র উপরে রোগী ভর্তি হচ্ছে।"

তিনি জানিয়েছেন শুরুতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, কদমতলা, বাসাবো, মোহাম্মদপুর এসব এলাকা থেকেই বেশি রোগী আসছিলেন। এখন ঢাকার প্রায় সকল এলাকা থেকে তারা রোগী পাচ্ছেন।

তবে ঢাকার কাছের কয়েকটি জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এসব এলাকা থেকেও অনেক রোগী আসছেন।

প্রাপ্ত বয়স্করাই বেশি ভর্তি হচ্ছেন এবং তীব্র পানিশূন্যতায় ভোগা রোগী সংখ্যায় অনেক আসছেন। তীব্র পানিশূন্যতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা প্রায় তিরিশ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছেন ডা. আলম।

গত বছর এরকম সময়ে হাসপাতালটিতে পাঁচশ মতো রোগী ভর্তি হতেন।

আগেভাগে কেন এত বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে?
সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআর'র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগির কয়েকটি কারণের একটি মনে করছেন, এই বছর গরম একটু আগেই শুরু হয়েছে এবং এর সাথে করোনাভাইরাস বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি পুরো শিথিল হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক দেখছেন তিনি।

তিনি বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল, মানুষজনের চলাচল ও জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে, প্রচুর মানুষ ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছিলেন।

"অনেক কিছু ধীরে ধীরে খুলেছে। কিন্তু এখন সবকিছু একদম পুরো চালু হয়ে গেছে। সব মানুষ একসাথে বের হয়েছে। সেই সাথে মার্চেই আমরা ৩৪, ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠতে দেখেছি। এই ধরনের তাপমাত্রায় খাবারে দ্রুত জীবাণু জন্ম নেয়। কোন সময়ের পর আর খাবার খাওয়া উচিত না - সেটা মানুষ বুঝতে চায় না"

"আর রাস্তার খাবার, লেবুর শরবত - এসব প্রাপ্ত বয়স্কদের ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর অন্যতম উৎস। সবাই একসাথে এসব খাচ্ছে এবং রোগটি ছড়াচ্ছে।"

এছাড়া তিনি মনে করেন, গত দুই বছর মানুষজন নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে ছিল। হাত পরিষ্কারের প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসা এবং স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার সাথে সাথে মানুষজনের ঘনঘন হাত ধোয়া এবং জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করার প্রবণতা কমে আসছে।

করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর মানুষজনের মধ্যে হাত পরিষ্কারের প্রবণতা অনেকে বেড়েছে।

ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ করা, পরিবেশন করা ও খাবার খাওয়ার আগে, টয়লেট থেকে বের হয়ে, বাইরে থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে নেয়া। কারণ হাত দিয়েই মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে।

ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হচ্ছে পানি। ঢাকার যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে সেখানে কলের পানিতে সমস্যা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

ঢাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মূলত উৎসে পানির মান পরীক্ষা করে। কিন্তু প্রচুর এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সাথে মিশে গেছে এবং এই সমস্যা সারা বছরের।

"এটা একটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। একটা থেকে আর একটা বিষয় প্রভাবিত হচ্ছে।"

কলেরা এবং ই-কোলাই

ডা. আলমগির বলছেন, "সাধারণভাবেই প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে ডায়রিয়া হয় তার মধ্যে প্রধান কারণ কলেরা এবং ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এগুলো ছড়ানোর মাধ্যমই হচ্ছে এসব জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ও পচা বাসি খাবার।"

যদিও বাংলাদেশে কলেরার জীবাণুর উপস্থিতি সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় না। কলেরা শব্দটির ব্যাবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়। বলা হয় মারাত্মক ডায়রিয়া।

তবে আইসিডিডিআর, বি এবার তাদের হাসপাতালে ভর্তি প্রতি ৫০তম রোগীর মল পরীক্ষা করে যে ফল পাওয়া গেছে তা হল ২৩ শতাংশের মতো রোগী কলেরায় আক্রান্ত। যদিও এটি পূর্ণ চিত্র নয়।

সংস্থাটি প্রতি বছর ডায়রিয়া রোগীদের মধ্যে কিছু রোগীর মল পরীক্ষা করে থাকে। তাতে সবসময় কলেরার উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং সরকারের কাছে সেই তথ্য দেয়াও হয়।

ডা. আলমগির বলছেন, "কলেরা প্রতিরোধে কার্যকরী টিকা রয়েছে। কিন্তু সেটি দিতে হয় বছরে দুই বার করে এবং প্রতি বছর। যা বাংলাদেশের বাস্তবতায় কঠিন। আর এখন কলেরায় আগের মতো মানুষ মারা যায় না। কারণ এর খুব ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। এক সময় তা ছিল না। তবে কোনটা কলেরা সেটা আলাদা করতে জানতে হবে। তাহলে চিকিৎসায় সুবিধা হবে।"

অন্যদিকে শিশুদের মধ্যে শীতকালে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এই মৌসুমেও শিশুদের রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হচ্ছে। এছাড়া শিগেলা ব্যাকটেরিয়াও একটি কারণ।

আলাদা করে বোঝার উপায় ও করণীয়

ডা. বাহারুল আলম জানিয়েছেন, খালি চোখে দেখে কখন সাবধান হতে হবে। ২৪ ঘণ্টায় তিন বা তার বেশি বার পাতলা পায়খানা হলে সেটিকে সাধারণত ডায়রিয়া বলা হয়। শুরুর দিকে বমি হয়ে থাকে। এছাড়া থাকে পেট কামড়ানো - এগুলো ডায়রিয়ার মূল লক্ষণ। এরকম হলে সাবধান হতে হবে।

তবে ডা. আলম বলছেন, "কলেরা হলে, আমরা বলি রাইস ওয়াটার স্টুল। অর্থাৎ চাল-ধোয়া পানির মতো দেখতে প্রচুর পাতলা পায়খানা। দেখা যাবে যে এত বেগ থাকবে যে বাথরুমে থেকে ফিরে আবার যাওয়ার মতো সময় থাকে না। কলেরায় খুবই দ্রুত শরীরে পানি শূন্যতা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যাবেন এবং শকে চলে যাবেন। তাই কলেরার বেলায় হাসপাতালে নিতে কোনভাবেই দেরি করা যাবে না।"

তিনি বলেন, ‘ই-কোলাই থেকে যে ডায়রিয়া হয় তাতে বমি হবে, পেট কামড়াবে, তার পর পাতলা মল হবে। রোটা থেকে ডায়রিয়া হলে মলের রঙ সবুজাভ হবে। শিগেলার হলে অল্প করে নরম মল হবে - তবে তাতে মিউকাস ও পরে রক্ত থাকতে পারে। গা-গোলানো ভাব থাকতে পারে।’

তার মতে, ‘এই দুটি ক্ষেত্রে বাড়িতে স্যালাইন খেয়ে চিকিৎসা চালানো যেতে পারে। খুব খারাপ হলে তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।’

তিনি বলছেন, সব ধরনের ডায়রিয়ার চিকিৎসা একটাই আর সেটি হল শরীর থেকে বের হয় যাওয়া পানি ও লবণ আগের যায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

ডায়রিয়া হলে রোগীকে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। স্যালাইনের পাশাপাশি সাধারণ পানি, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল পানিয় দিতে হবে। সূত্র: বিবিসি

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি