ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

পর্ব-২

ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি ও দুঃশ্চিন্তা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়

প্রকাশিত : ২০:১৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১১:১০, ২ অক্টোবর ২০১৭

মানবদেহ স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি। মহাবিশ্বে এত চমৎকার, এত বুদ্ধিমান, এত সৃজনশীল, এত সংবেদনশীল আর কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়নি। এই মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে হার্ট বা হৃৎপিন্ড। বুকের মধ্যখানে দুই ফুসফুসের মাঝে হৃৎপিন্ড অবস্থিত। হৃৎপিন্ডের ৪টি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। উপরের দুইটিকে অ্যাট্রিয়াম এবং নীচের দুইটিকে ভেন্ট্রিকুল বলে। হৃৎপিন্ড চারিদিকে পেরিকার্ডিয়াম নামক আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে। হৃৎপিন্ডকে আমরা বলতে পারি একটি শক্তিশালী পাম্প, যা জীবদ্দশায় সাড়ে ৪ কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। প্রতিদিন ১ লাখ হার্টবিটের মাধ্যমে ৬০ হাজার মাইল পাইপলাইনের মধ্যদিয়ে হৃৎপিন্ড দেহের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে। হৃৎপিন্ড যে ধমনীর মাধ্যমে নিজের জন্য রক্ত পাঠায় তার নাম করোনারি ধমনী। ডান ও বাম এই প্রধান ২টি করোনারি ধমনীর মাধ্যমে হ্ৎৃপিন্ডে রক্ত সঞ্চালিত হয়।

হৃদপিন্ড বা হার্টের অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এবং সবচেয়ে বেশি যে রোগটি হয় তা হলো করোনারি আর্টারী ডিজিজ বা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বা করোনারি হৃদরোগ। করোনারি ধমনীর দেয়ালে হলুদ চর্বি জমে রক্ত চলাচল কমে গেলে রোগী বুকে ব্যথা অনুভব করেন, বিশেষ করে কিছুদূর হাঁটলে বা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে বুকে ব্যথা হয়। সাধারণত: বুকের বাম দিকে বা বুকের মধ্যখানে এই ব্যথা অনুভূত হয়। অধিকাংশ রোগী বুকের মধ্যে ভার ভার বা চাপ অনুভব করেন-অনেকটা বুকের চারপাশে ব্যান্ডের মত। কখনও কখনও রোগী এক ধরনের শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। বুকের এই ব্যথা ঘাড়, থুতনি, বাহু বিশেষ করে বাম হাত বা রিস্ট-এ চলে যেতে পারে। কখনও বা এই ব্যথা উপরের পেটে বা পিঠের উপরের দিকে দুই হাড়ের মধ্যে অনুভূত হতে পারে। সাধারণত: বিশ্রাম নিলে বা জিহ্বার নিচে নাইট্রেট  জাতীয় ওষুধ নিলে এই ব্যথা কমে আসে।

করোনারি হৃদরোগ প্রধানত দু’ধরনের 

১.       এনজাইনা পেকটরিস

২.      মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন

এনজাইনা পেকটরিস

করোনারি ধমনীতে হলুদ চর্বি জমার কারণে করোনারি ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল কমে আসে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ থেকে হৃদপিন্ড বঞ্চিত হয়। ফলে রোগী বুকে ব্যথা অনুভব করেন।

মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন

যদি কোনো কারণে করোনারি ধমনী দিয়ে পুরোপুরি রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসে তখন রোগী বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা বুক, গলা, ঘাড়, ওপরের পেট, হাত বা পিঠেও চলে যায়। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে। আস্তে আস্তে রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং দ্রুত চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হলে রোগী মৃত্যুর মুখে পতিত হন।

বিশ্বে প্রতিবছর দেড় কোটিরও বেশি মানুষ করোনারি হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। আর পাশ্চাত্যে মোট মৃত্যুর শতকরা ৪৫ ভাগই ঘটে হৃদরোগে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রতি ৫ জনে ১ জনের মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। পাশ্চাত্যের অন্ধ-অনুকরণ আর ভ্রান্ত জীবনাচরণের কারণে বাংলাদেশসহ প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এ রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হৃদরোগ মহামারি আকারে দেখা দেবে। আর এই রোগ একদিনে হুট করে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে ধমনীতে কোলেস্টেরল জমে মূলত: এ রোগের সূত্রপাত ঘটে।

বিজ্ঞানীরা যে সকল কারণকে হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে থাকেন তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো:

১. বয়স : বয়স বাড়ার সাথে সাথে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

২.লিঙ্গ : মহিলাদের চেয়ে পুরুষেরা হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে মেনোপজের পরে মহিলাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

৩. বংশগত : বাবা-মায়ের হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অধিক থাকে। এর মূল কারণ পরিবারের একই খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপানের অভ্যাস।

৪. ধূমপান : হৃদরোগ হবার পেছনে ধূমপানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল ব্যক্তি নিয়মিত ধূমপান করে থাকেন তাদের হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি থাকে।

৫. উচ্চ রক্তচাপ : উচ্চ রক্তচাপ করোনারি হৃদরোগের একটি মারাত্মক রিস্ক ফ্যাক্টর। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিন্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

৬. রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রার আধিক্য : রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার আধিক্য হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর।

৭. ডায়াবেটিস : হৃদরোগ হবার পেছনে ডায়াবেটিসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

৮. অতিরিক্ত ওজন এবং মেদস্থুলতা : অধিক ওজন হলে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃদপিন্ডের অধিক কাজ করতে হয়। যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৯. শারীরিক পরিশ্রমের অভাব : শারীরিকভবে নিস্ক্রিয় লোকদের হৃদরোগ হবার প্রবণতা দেখা যায়। অলস জীবন-যাপন করোনারি হৃদরোগের জন্য আরেকটি রিস্ক ফ্যাক্টর।

কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এ কারণগুলো ছাড়াও যে বিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মনোযোগ দিচ্ছেন তা হলো স্ট্রেস বা টেনশন। এমনকি বিজ্ঞানীরা উপরোক্ত সবগুলো কারণের মধ্যে একক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে স্ট্রেসকে চিন্থিত করছেন।

কেননা গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তির রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল লেভেল, উচ্চ রক্তচাপ বা ধূমপানের অভ্যস থাকা সত্ত্বেও স্ট্রেস- ফ্রি থাকার কারণে তিনি হৃদরোগ থেকে মুক্ত রয়েছেন। আবার উপরোক্ত কারণগুলো না থাকা সত্ত্বেও শুধু স্ট্রেসের কারণে কোনো ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি বলেছেন, কোলেস্টেরল বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে করোনারি ধমনী প্রায় ব্লক করে ফেললেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। 

■       কোরিয়া যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের নিয়মিত অটোপসি করা হতো। ডাক্তাররা তখন সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন যে, নিহত তরুণ সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই ধমনী চর্বি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে (Advance Stage of Atherosclerosis) এবং দ্রুত হার্ট অ্যাটাকের পথে এগুচ্ছে। এদের মধ্যে ১৯ বছর বয়স্ক তরুণ সৈনিকও ছিল। ডা. ক্রিচটন প্রশ্ন তোলেন, তরুণ ধমনীগুলো এভাবে চর্বি জমে বন্ধ হওয়ার পরও সাধারণভাবে মধ্য বয়সে এসে কেন হৃদরোগের আক্রমন ঘটে? যদি শুধু করোনারি ধমনীতে চর্বি জমাটাই হৃদরোগের কারণ হতো তা হলে এই তরুণ সৈনিকদের মৃত্যু গুলির আঘাতে নয়, হার্ট অ্যাটাকেই হতো।

■       আবার দেখা গেছে, করোনারি ধমনীর ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে; আবার একেবারে পরিস্কার ধমনী নিয়েও অপর একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোজেনম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।

■       এই প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রয়েছে ভ্রান্ত-জীবনদৃষ্টি। ভ্রান্ত-জীবনদৃষ্টির কারণে যে জিনিসটি প্রথম তৈরি হয় তা হলো টেনশন বা স্ট্রেস। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আবেগের আগ্রাসন, কাজের বাড়তি চাপ প্রভৃতি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। জীবনে ক্রমাগত আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া, কাজ-কর্মে তাড়াহুড়ো, আধুনিক জীবনযাত্রায় নিত্য দিনের দুর্ভাবনা এককথায় স্ট্রেস সরাসরি আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া ও হৃৎপিন্ডের উপর প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত টেনশন বা স্ট্রেসের ফলে শরীর থেকে এড্রেনালিন, নর-এড্রেনালিন ও কর্টিসোল নামক স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়।

ফলশ্রুতিতে দেহের অধিকাংশ পেশী যে পরিমাণ সংকুচিত হয় সেই পরিমাণ শিথিল হতে পারে না। এর মধ্যে যেমন বড় বড় পেশী রয়েছে তেমনি  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেশীও রয়েছে। ফলে তৈরি হচ্ছে ঘাড়ে ব্যথা, কাঁধে ব্যথা, পিঠে ব্যথা। আবার করোনারি ধমনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে তৈরি হচ্ছে  Coronary artery spasm. 

■       সম্প্রতি ডা. আলবা সাবাই বৈরুতে কিছু মানুষের উপর নিরীক্ষা চালান যারা গত ১৪ বছর যাবৎ যুদ্ধের কারণে ক্রমাগত টেনশন বা স্ট্রেসে থেকেছেন। তিনি এনজিওগ্রাম করে প্রত্যেকের করোনারি ধমনীতে ব্লকেজ পান।

■       আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপে রক্তের কোলেস্টেরল লেভেল বৃদ্ধি পায় এবং এর সাথে খাদ্য গ্রহণের কোনো সম্পর্ক নাই। কার রেসিং এর পূর্বে ৫০০ ইন্ডিয়ানাপোলিস কার রেস ড্রাইভারের রক্ত পরীক্ষা করা হয় এবং রেস শেষ হবার পরও রক্ত পরীক্ষা করা হয়। দেখা গেছে, রেসের পূর্বে তাদের প্রত্যেকের রক্তের কোলস্টেরল লেভেল বেশি ছিল।

এছাড়া আমেরিকায় ট্যাক্স একাউন্ট্যান্টদের রক্তের কোলস্টেরল লেভেল বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় ১৫ এপ্রিল এর আগে-পরে বেশি থাকে। আবার দেখা গেছে, মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা চলাকালীন রক্তের কোলেস্টেরল লেভেল অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে।

লেখক : কোঅর্ডিনেটর, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব।

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি