ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

পর্ব-৬

হৃদরোগ নিরাময় করে প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনাচার

প্রকাশিত : ১৫:৫৮, ৩ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৬:৪৯, ৭ অক্টোবর ২০১৭

হৃৎপিণ্ডের যত ধরনের অসুখ রয়েছে, তার মধ্যে করোনারি হৃদরোগ অন্যতম। ধূমপান, চর্বিযুক্ত খাবার, শাররিক পরিশ্রমের অভাব ইত্যাদি এ রোগের অন্যতম কারণ। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় শুধু ও ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস অপারেশনের মাধ্যমে রোগীর ব্লকেজের চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসক-জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি , অত্যধিক মানসিক চাপ ও ‍দুশ্চিন্তা হৃদরোগের একটি অন্যতম প্রধান অনুঘটক,যার কোনো সমাধান প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় নেই।

এছাড়া অপারেশনের পর রোগী যখন আবার ধূমপান ,ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবারসহ পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরে যায়, সে আবারও আক্রান্ত হয় হৃদযন্ত্রের নানা জাটিলতায়। তাই হৃদরোগ থেকে পরিপূর্ণ নিরাময়ের জন্যে প্রয়োজন ধূমপান বর্জন, জীবনধারায় পরিবর্তন এবং টেনশনমুক্ত জীবন। আমিও আমার রোগীদেরকে এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ ‍দিই ।

টেনশনমুক্ত প্রশান্ত জীবনের জন্যে মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত । মেডিটেশন ও জীবনাচার পরিবর্তনের মাধ্যমে যারা হৃদরোগ মুক্ত হয়েছেন,আমি তাদের অভিনন্দন জানাই । এদের মধ্যে অনেকেই অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারতেন । কিন্তু তা হন নি;বরং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাটি তারা নিতে পেরেছেন 

অপারেশনকে ভয় করেন না এমন মানুষ নেই,তাই অপারেশনের চেয়ে ঝঁকিহীন এমন একটি পদ্ধতির মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার । হৃদরোগ থেকে মুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের নিজেদের বক্তব্যেই আমি শুনেছি। সৎ সাহস না থাকলে এ কথাগুলো তারা এত সহজে বলতে পাতেন না । সত্য বলেই সৎ সাহস ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এ কথাগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। আর সত্য বলতে কোনো ভয় থাকা উচিত নয়। কারণ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে শেষপযর্ন্ত সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানসিক প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনধারা হৃদরোগ নিরাময় করে-এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। নানা গবেষণা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলেই মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান প্রধান বই ও জার্নালগুলোতে এ কথাগুলো ছাপা হয়েছে । এ পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি যদি ভালো থাকতে পারেন তবে কেন অনর্থক কাটাছেঁড়ে করবেন ?

প্রযুক্তির ক্রমউৎকর্ষের ফলে শহরে কিংবা গ্রামে কোথাও আমরা এখন আর হাঁটি না,সবত্রই গাড়িতে চলাচল করি। অর্থাৎ আমাদের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে শারীরিক পরিশ্রমহীন। আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শাক-সব্জির বদলে এখন আমরা ফাস্টফুড,ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব খাবার যতই সুস্বাদু হোক,এগুলো কিন্তু শরীরের জন্যে বিপজ্জনক। আর ধূমপানের কথা তো বলাই বাহুল্য। সিগারেটের নিকোটিন হৃৎপিন্ডের ধমনীকে সংকুচিত করে । ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হয়,যা করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনের নানা দুশ্চিন্তা ও টেনশন।

তাই আপনার হৃৎপিন্ডের সুস্থতার জন্যে ধূমপান বর্জন করুন, জীবন-অভ্যাসে পরিবর্তন আনুন এবং মনে প্রশান্তি সৃষ্টি করুন। আপনি ভালো থাকবেন। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমেরিকায় ডা.ডিন অরনিশ শত শত হৃদরোগীকে এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস ছাড়াই সুস্থ করে তুলেছেন। হৃদরোগের এ অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাপদ্ধিতি আবিস্কারের জন্যে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত বলে আমি মনে করি। সমস্ত মেডিকের জার্নাল, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, এর ভিত্তি আছে,এত মিথ্যা কিছু নেই। চিকিৎসক-জীবনে আমি নিজেও এর বহু প্রমাণ পেয়েছি।

নজরুলের একটি কবিতায় আছে,‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেও না তাহার কাছে’। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বাস এবং আশাকে সঙ্গী করে রাখবেন। এই আশা এবং বিশ্বাসই আপনাকে সুস্থ করে তুলবে,সাফল্য এনে দেবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছেন তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন অর্থাৎ সবসময় কৃতজ্ঞচিত্ত থাকুন।

মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনাচার চর্চা করে যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের সুস্থতার মূলেও রয়েছে এই বিশ্বাস। বিশ্বাস করে এগিয়ে গেছেন বলেই তারা আজ সুস্থ,হৃদরোগমুক্ত। নি:সন্দেহে তারা ভাগ্যবান। তাদেরকে বলি-আপনারা এ অভিজ্ঞতা সবাইকে জানান,পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করুন। আপনাদের জন্যে কিংবা পত্রিকার জেন্যে নয়,মানুষের জন্যে। যারা হৃদরোগ থেকে মুক্তি চান,পরিত্রাণ চান, অপারেশনের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে চান, বাঁচতে চান তাদের জন্যে প্রচার করুন। সমাজের জন্যে, জাতির জন্যে সর্বোপরি মানুষের কল্যাণার্থে এ সুসংবাদ সবার কাছে পৌঁছে দেয়া একটি নৈতিক কর্তব্য বলে আমি মনে করি ।

আমি বিশ্বাসের সাথে যে কথাগুলো বললাম, তাতে আমরা পেশার কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পেশা তার যোগ্য সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকবে। প্রায় ২০ বছর আগে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শিথিলায়ন ক্যাসেটের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। সেদিনও ‘প্রশান্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক ভাষণে একজন চিকিৎসক হিসেবেই আমি বলেছিলাম-‘শুধু ট্যাবলেট,মিকশ্চার বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে সব রোগমিক্তি সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেক চিকিৎসককেই তার পেশাগত জীবনে এমন কিছু রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়,যাদের রোগের সাথে কোন না কোনভাবে টেনশন জড়িত। দেখা গেছে,হাসপাতালের বহির্বিবাগে যে রোগীরা যান, তাদের মধ্যে শতকারা ৪০ ভাগেরই কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। কাউন্সিলিং বা সৎ পরামর্শ, আত্মবিশ্বাস এবং প্রশান্তিতে এ সমস্ত রোগের মুক্তি হয়। আর অস্থির-অশান্ত আধুনিক মানুষের জীবনে প্রশান্তির সুবাতাস আনতে পারে মেডিটেশন। কোয়ান্টাম মেডিটেশন মানুষের মনে প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে রোগ নিরাময়কে ফলপ্রসূ করে, যা এখন পাশ্চাতে বিজ্ঞিান হিসেবে স্বীকৃত। তাই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিপূরক হিসেবে কোয়ান্টাম মেথড চমৎকার কাজ করতে পারে। যেসব রোগ ওষুধের প্রয়োজন নেই,তার নিরাময়ে কোয়ান্টামই হতে পারে সার্থক বিকল্প।

আসল শরীরের চেয়ে মন অনেক বেশি শক্তিশালী। মনের গতি, শক্তি, পরিধি সবই ব্যাপক। মনের এই দুর্দমনীয় শক্তির প্রভাবে শরীরে এমন কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে,এমনকি রোগ নির্মূলেও সাহায্য করে।

যুগে যুগে মহামানবরা,নবী-রাসুলরা বিভিন্ন রোগ নিরাময় ক্ষেত্রে ধ্যানের এ শক্তিকে  কাজে লাগিয়েছেন। এটি তাই নতুন কিছু নয়। এটি হাজার বছরের শাশ্বত চেতনারই একটি আধুনিক ও সমন্বিত রূপ,যার উৎস এই প্রাচ্য। বর্তমানে হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের এ প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত। তাই আমি আশা করবো, হৃদরোগ নিরাময়ের এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

পরিশেষে এটাই বলি, আপনার সুস্থতা ও নিরাময়ের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্র সর্বোপরি সুস্থ জীবনের জন্যে সঠিক দৃষ্ঠিভঙ্গি অনুসরণ করুন। অর্থাৎ ইতিবাচক ও কৃতজ্ঞচিত্ত হোন। প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। নিয়মিত হাঁটুন, ব্যায়াম করুন এবং টেনশনমুক্ত জীবনযাপনে করুন। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বাস এবং আশা নাই যার, তার কছে থেকে দূরে থাকুন। সবসময় আশাবাদী, বিশ্বাসী ও ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকুন। আপনি ভালো থাকবেন।

**অধ্যাপক ডা. ‍নুরুল ইসলাম প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশে ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ। জাতীয় এ অধ্যাপক কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব প্রকাশিত হৃদরোগ নিরাময়ে বিশেষ মেডিটেশন সিডির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দেন ।  

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি