ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

পর্ব -১০

টেনশন ও স্ট্রেস হৃদরোগের অন্যতম কারণ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:২৮, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

গত কয়েক দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, হৃদরোগের অন্যতম কারণ মানসিক। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো ক্রমাগত টেনশন ও স্ট্রেস।

কেননা গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য কিংবা ধূমপানের অভ্যাস না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র স্ট্রেসের কারণেই একজন মানুষ করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

দেখা গেছে, ধমনীতে ৮৫% ব্লকেজ নিয়ে একজন মানুষ ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে, ধমনীতে কোনো ব্লকেজ নেই কিন্তু হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। এর কারণ কি?

হৃদরোগীদের কেউ কেউ বলেন, সারাজীবন নিয়ম মেনে চলেছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছি, কোলেস্টেরলের পরিমাণও ছিল স্বাভাবিক, আমার কেন হার্ট অ্যাটাক হলো? কিন্তু যদি তার পুরো কেস-হিস্ট্রি অর্থাৎ পারিবারিক সামাজিক পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয় তবে হয়তো দেখা যাবে, আজীবন তিনি স্ট্রেস নিয়েই বেঁচে ছিলেন। কিংবা দৈনন্দিন ছোটখাটো সব ব্যাপারেই তিনি ভীষণ টেনশনে ভুগতেন।

আসলে সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন ক্রমাগত স্ট্রেস আমাদের জীবনের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে। হৃদয়ের পাশাপাশি তখন আক্রান্ত হয় হৃদযন্ত্রও, যার অন্যতম পরিণতি করোনারি হৃদরোগ এবং অন্যান্য মানোদৈহিক রোগব্যাধি। মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক।

অনেকে মনে করেন,এনজিওগ্রাম ব্লক ধরা পড়েছে, এখন স্টেন্ট বা রিং লগিয়ে নিলে কিংবা বাইপাস অপারেশন করে নিলেই হবে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আর নেই। কিন্তু সত্য হলো, স্ট্রেস বা টেনশনের বৃত্ত থেকে যদি একজন মানুষ বেরিয়ে আসতে না পারেন, তবে হৃদরোগের ঝুঁকিমুক্ত থাকা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা তার শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়, আর্টারিতে যে কয়টাই স্টেন্ট লাগানো হোক।

যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মেয়র ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোনেম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি।

ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স (Fight or flight response) হচ্ছে আমাদের অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন গুহা বা জঙ্গলে ছিলো তখন হিংস্র বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তাদের একটাই পথ ছিলো-হয় প্রাণিটার সাথে লড়তে হবে অথবা এত জোরে দৌড়াতে হবে যাতে সেই প্রাণিটা তাকে ধরতে না পারে।

এখন বন্যপাণীর সাথে লড়াই করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্সটা আমাদের নার্ভাস সিস্টেম থেকে গেছে।

ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তা ও স্ট্রেস যে করোনারি ধমনীতে ব্লকেজের কারণ, তা বোঝা যায় ডা.আলবা সাবাই পরিচালিত একটি গবেষণায়। তিনি বৈরুতে কিছু মানুষের উপর একটি গবেষণা চালান, একযুগেরও বেশি সময় ধরে যারা বিভিন্ন কারণে স্ট্রেস-আক্রান্ত ছিলেন। তাদের এনজিওগ্রাম করে ডা.সাবাই, প্রত্যেকের করোনারি ধমনীতে ব্লকেজ শনাক্ত করেন।

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, নেতিচিন্তা, আবেগের আগ্রাসন আর ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টির কারণে চাওয়া এবং পাওয়ার ফারাক অর্থাৎ জীবনের অংক মেলাতে না পারার হাহাকার ও পণ্যদাসত্ব আমাদের মধ্যে সারাক্ষণই এক দুঃসহ স্ট্রেস তৈরি করে চলেছে। সবমিলিয়ে ভেতরে চলছে এক অবিশ্রান্ত ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স। ফলে প্রায় সারাক্ষণই সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টিম উদ্দীপ্ত থাকছে এবং নিঃসৃত হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্রেস-হরমোন: এড্রিনালিন, নর-এড্রিনালিন, কর্টিসল।

দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতে তাকলে শরীরের স্নায়ু ও পেশিগুলো যে পরিমাণে সংকুচিত হয় সে অনুপাতে শিথিল হতে পারে না। যার ফলাফল নানারকম সাইকোসোমাটিক বা মনোদৈহিক রোগব্যধি। এ অযাচিত সংকোচন হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনীকেও ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত করে (Coronary artery spasm), যা ধমনী-পথে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলকে ব্যাহত করে। শুধু তাই নয়, সারাক্ষণই মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস-হরমোনের প্রভাবে শরীরে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা,অনিদ্রা এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা। ফলে বেড়ে যায় করোনারি ধমনীতে ব্লকেজ তৈরির সম্ভাবনা।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রেস-এ থাকাকালে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমান বৃদ্ধি পায়,খাদ্যাভ্যাস যেমনই হোক না কেন। যুক্তরাষ্ট্রে একটি কার রেসিং-এর পূর্বে ৫০০ প্রতিযোগীর রক্ত পরীক্ষা করা হয় এবং প্রতিযোগিতা শেষ হবার পর আরেকবার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। দেখা গেছে, রেসের পূর্বে তাদের প্রত্যেকের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি ছিল। এছাড়াও আমেরিকায় ট্যাক্স-একাউন্টেন্টদের লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ট্যাক্স জমা দেয়ার আগে-পরের সময়টাতে তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ গবেষণায় মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন আমেরিকার হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর ও প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.হার্বার্ট বেনসন। বোস্টনের ম্যাসাচুসেট্স জেনারেল হাসপাতালে তিনি ‘মাইন্ড বডি ইনস্টিটিউট’প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে টেনশনের মনোদৈহিক প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর গবেষণা করে। তিনি দেখিয়েছেন, সাধারণভাবে যে রোগগুলোর সাথে আমরা বেশি পরিচিত তার একটা বড় অংশের সাথেই রয়েছে টেনশনের নিবিড় যোগাযোগ। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস,বিভিন্ন রকম পেটের পীড়া, কোষ্ঠকঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক আলসার, আইবিএস, ঘাড় ও মাথাব্যথা, অবসাদ, অনিদ্রা, হাত-পয়ের তালু ঘামা ইত্যাদি।

শারীরিক উপসর্গ হিসেবে প্রকাশ পেলেও এসব রোগের আসল উৎস কিন্তু মন। মনে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে জমতে থাকা কষ্ট, টেনশন, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। ‍চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাই এ রোগগুলোকে বলা হয় সাইকোসোমাটিক ডিজিজ বা মনোদৈহিক রোগ।

আমরা যদি দেখি, টেনশন সৃষ্টি হলে শরীরে কী হয়? টেনশনের ফলে স্নায়ু এবং পেশি সংকুচিত (Tense) হয়। বিশ্রাম বা ঘুম পেশির এই অযাচিত সংকোচন দূর করতে পারে। কিন্তু স্নায়ুর টেনশন বিশ্রাম বা ঘুমে দূর হয় না। এটি থেকেই যায় এবং ক্রমাগত এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় এই রোগগুলোর সূত্রপাত ঘটে। তাই স্নায়ুর টেনশন দূর করা অত্যন্ত জরুরি।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগেও টেনশনমুক্তির জন্যে কোনো কার্যকরী ওষুধ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনগুলো সম্পর্কে যারা সচেতন তারা জানেন যে, কার্যকরীভাবে টেনশন দূর করার বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে শিথিলায়ন (Relaxation)। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ বিষয়টি আজ প্রমাণিত সত্য।

শিথিলায়নকালে একজন মানুষ তার মনের গভীর প্রবেশ করে। মন প্রশান্ত হয়। তখন ব্রেন থাকে সবচেয়ে কার্যকরী অবস্থায় অর্থাৎ আলফা লেভেল। শিথিলায়নে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি হয়। নিয়মিত শিথিলায়নে মনে একটা স্থায়ী প্রশান্তি আসে, ফলে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো তখন মনকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করে। আর দুঃশ্চিন্তা ও শিথিলায়ন একসাথে সম্ভব নয়। কারণ, শরীর শিথিল হলে দেহ-মনে কখনো টেনশন বা দুঃশ্চিন্তা থাকে না।

প্রফেসর ডা.হার্বার্ট বেনসন দীর্ঘ গবেষণার পর প্রমাণ করেছেন যে, গভীর শিথিলায়নে হার্টবিট কমে, দেহে ব্যথা বা আঘাতের অনুভূতি হ্রাস পায়, উচ্চ রক্তচাপ কমে, দমের গতি ধীর হয়ে আসে, রক্তে ল্যাকটেট ও এড্রিনালিন-এর পরিমাণ হ্রাস পায়, প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের তৎপরতা বাড়ে, দেহকোষে অক্সিজেন গ্রহণের চাহিদা কমে। সেইসাথে বাড়ে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শরীর আপনা থেকেই রোগমুক্তির প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে।

সূত্র: কোয়ান্টাম হার্টক্লাব এর হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ গ্রন্থ থেকে সংকলিত (সংক্ষেপিত)।

  ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি