ওষুধ মৃত্যুর কারণ
অভ্যাস পরিবর্তনেই সুস্থতা
প্রকাশিত : ২০:৪১, ১৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৪২, ১৮ মার্চ ২০১৮
আমরা সাধারণত সামান্য অসুস্থ হলেই ওষুধের দিকে ঝুঁকে পড়ি। ওষুধ কি আমাদের রোগ সারাতে পারে? বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে এই ওষুধও কোনো কোনো সময় আমাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বিভিন্ন গবেষণায় ওঠে এসেছে শুধু ওষুধ সেবনের কারণেই প্রতিবছর পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। ওষুধই যদি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার কোনো উপায় কি নেই? গবেষক এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন ওষুধ ছাড়াও দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার উপায় রয়েছে। কিছু অভ্যাস আছে যা পালন করলে পাল্টে যাবে আপনার জীবন। এমন অভ্যাসই এনে দিতে পারে আপনার সুস্থতা।
এক সময় সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ মারা যেত আর এখন মারা যাচ্ছে অসাংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৫৩ ভাগ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক ব্যাধি।
এসব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ ছুটে যাচ্ছে ডাক্তারের কাছে। আর ডাক্তার ওষুধ লিখে দিচ্ছে। রোগীরা সেসব ওষুধ সেবন করছে। এখন প্রশ্ন হলো ওষুধ খেলেই কি আমাদের রোগ নিরাময় সম্ভব? বিভিন্ন গবেষণা এবং জার্নালের তথ্যে উঠে আসে ভয়ঙ্কর কিছু চিত্র। যে ওষুধে মানুষের জীবন রক্ষা পাওয়ার কথা সে ওষুধেই মানুষ তার প্রিয় প্রাণটি হারাচ্ছে।
আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যমতে, ১৯৭৮ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য ওষুধ খেয়ে প্রায় ১৫ লাখ রোগী মৃত্যুবরণ করে। এতে আরও দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০ শতাংশ রোগী ওষুধ খেয়ে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে করা এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রতিবছর ওষুধ সেবন করে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর কারণ ড্রাগ প্রেসক্রিপশন বলে জানা যায়।
সুতরাং ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগ নিরাময় হয় এটি একটি ভূল ধারণা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ এর প্রয়োজন হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়া রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক জীবনাচার। অভ্যাসের পরিবর্তন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, আপনার সুস্থতা ও নিরাময়ের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। তাই সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ ইতিবাচক ও কৃতজ্ঞচিত্ত হওয়া। প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা। নিয়মিত হাঁটুন, ব্যায়াম করুন এবং টেনশনমুক্ত জীবনযাপন করুন। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বাস এবং আশা নাই যার, তার কাছ থেকে দূরে থাকুন। সব সময় আশাবাদী, বিশ্বাসী ও ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকুন। আপনি ভালো থাকবেন।
রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। ওষুধ কখনোই মানুষকে আরোগ্য দিতে পারে না। সুস্থতার জন্য বিশ্বাসী হতে হবে। সচেতনভাবে উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য প্রতিদিন একটু একটু করে সুস্থ জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারলে সুস্থ থাকা সম্ভব।
আমরা দেখতে পাই, সারা বিশ্বে নিরাময়ের জন্য যে সব ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, অসাধু গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের যোগসাজশে ওষুধ কোম্পানিগুলো সময় ও অর্থ বাঁচানোর জন্য বা অতিমুনাফার লোভে অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ভাড়া করা গবেষকরা মানবদেহে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন না করেই শুধু জীবজন্তুর ওপর কিছু পরীক্ষা চালিয়ে ওষুধ বাজারজাত করে থাকে। ফলে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে অপরিসীম।
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০০৪ সালে বিশ্বের খ্যাতনামা ওষুধ কোম্পানি মার্ক তাদের ভায়োক্স ওষুধটি হাজার হাজার হৃদরোগ ও স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর কারণে বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
আরও একটি ওষুধ থ্যালিডোমাইডের কথা সর্বজনবিদিত। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ ওষুধটি গর্ভবতী মহিলাদের প্রদানের কারণে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার শিশু অঙ্গ বিকৃতি বা অঙ্গহীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করার পর ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয় ওষুধটির আবিষ্কারক কোম্পানি গ্রুনেনথাল। এসব করুণ পরিণতির জন্য জীবজন্তু ও মানুষের ওপর ওষুধগুলোর অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষকদের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, বিশ্বের বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো চায় না যে, আমরা ওষুধ সম্পর্কে সত্য কথাগুলো জেনে ফেলি। তারা এও চায় না, ওষুধের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করি বা ঔৎসুক্য প্রকাশ করি। যদিও এসব ওষুধের ওপর আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করে। তবে আমাদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যে নেই, তা কিন্তু নয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো মনে করে ও স্বীকার করে, যখনই আমরা কোনো ওষুধ গ্রহণ করি বা খাদ্য ও পরিবেশ থেকে উদ্ভূত কোনো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসি, তখন আমরা হয়ে যাই তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সত্যিকার গিনিপিগ।
এ ধরণের অপর্যাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বহু কোম্পানী বাজারে ওষুধ নিয়ে আসে। যার ফলে লক্ষ লক্ষ রোগী অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। যার সঠিক কারণ কেউ জানতেই পারছে না। তাই ওষুধ নির্ভর না হয়ে নিজেদেরকেই উদ্যোগি হতে হবে নিজেদের জীবন রক্ষার।
এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগে. (অব.) ডা. আবদুল মালিক বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি অধিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানন্সার এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। নিরাময়ের এক অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষ শুধু একটি দেহ নয়, দেহ এবং আত্মা এ দুয়ের সমন্বয়ে একজন মানুষ। পরিপূর্ণ সুস্বাস্থ্যর জন্য তাই দেহ ও মন উভয়েরই সুস্থতা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন স্রস্টার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রকৃত জ্ঞান অর্জন এবং সব সময় সৎকর্ম করা। পাশাপাশি মেডিটেশন এর মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলেতে পারি। বর্তমান সময়ে যত রোগ হচ্ছে, তার একটা বড় কারণ হলো মানুষের ভুল জীবনযাপন।’
সুতরাং ওষুধ নির্ভর না হয়ে আমরা যদি জীবন পদ্ধতির সঠিক দৃস্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি, আমাদের জীবনাচারকে বদলাতে পারি তাহলে ওষুধ ছাড়াই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব।
এসি/ এআর