ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

জরায়ু মুখ ক্যানসার কাদের হয়, লক্ষণ কী: ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:০৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

এ দেশের নারীরা কয়েক ধরনের রোগে বেশি ভোগে। এর মধ্যে-পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, জরায়ু মুখে ক্যানসার এবং ব্রেস্ট ক্যানসার অন্যতম। ইউটেরাসের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জরায়ুর মুখ ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে নারীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ জরায়ু মুখ ক্যান্সার। বাংলাদেশে ক্যান্সারাক্রান্ত নারীদের মধ্যে শতকারা ৩০ ভাগই হচ্ছেন জরায়ু মুখ ক্যান্সারের শিকার। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার নারী জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।

কেন হয় জরায়ুমুখ ক্যানসার

এক ধরণের ভাইরাস এই ক্যানসারের জন্য দায়ী। এই ক্যানসারের নাম হচ্ছে এইচপিভি বা হিউমেন পেপুলুমা ভাইরাস। এই ভাইরাসটা সেক্সুয়াল রুটে একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। এই ভাইরাসটা যখন জরায়ুর মুখে আক্রমণ করে তখন জরায়ুর মুখে কিছু পরিবর্তন আসে এবং শেষ অব্ধি তা ক্যান্সারে রূপ নেয়।

যেসব মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়, যেসব মেয়েরা অল্প বয়সে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে, যেসব মেয়েদের খুব ঘন ঘন প্রেগন্যান্সি বা ডেলিভারি হয়, যেসব মেয়েদের সিগারেট খাওয়ার হিস্ট্রি থাকে, যেসব মেয়েরা বহুগামী কিংবা স্বামীরা অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে- এমন ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাসে নারীদর বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

লক্ষণ

আমাদের (ডাক্তার)  কাছে যেসব রোগীরা আসেন তাদের অভিজ্ঞতায় যেটা বেশী দেখি তা হলো, একটা মেয়ের প্রচণ্ড সাদা স্রাবের সমস্যা হয়। এই স্রাবটা খুবই দুর্গন্ধযুক্ত হয়। পানির মতো হয়ে এই স্রাব নি:সরিত হয়। অনেক সময় প্যাড বা কাপড় পড়তে হয় এই সাদা স্রাব রোধ করার জন্য।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

এই রোগের জন্য এখন সরকারিভাবে একটা টেস্ট আছে। একে বলা হয় `ভায়া`। এটা সব সরকারি হাসপাতালগুলোতে আছে। এই `ভায়া` টেস্টটা বিনামূল্যে করা হয়। ভায়া টেস্টের মাধ্যমে দুটো জিনিস নির্ণয় করা যায়। একটা হচ্ছে জরায়ুর মুখে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা আছে নাকি নেই।

এজন্য ভায়া টেস্টের পর দু’ধরণের কার্ড দেয়। একটা হচ্ছে লাল কার্ড। অন্যটি হচ্ছে নীল কার্ড। নীল কার্ড যাদের দেওয়া হয়, তাদের বলা হয়, আপনার জরায়ুতে এখন পর্যন্ত ক্যানসারের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। আপনি তিন বছর পর আবার পরীক্ষা করতে আসবেন। আর যাদের লাল কার্ড দেওয়া হয় তাদের বলা হয় আপনার জরায়ুতে ক্যান্সারের সম্ভাবনা আছে। আপনি নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে `কল্পোস্কপি` বা `বায়োপসি` করান।

তখন তারা আমাদের কাছে আসে। আমরা তাদের জরায়ুর মুখ থেকে অল্প একটু টিস্যু নিয়ে বায়োপসি করি। বায়োপসি রিপোর্টে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন তার চিকিৎসা করা হয়। জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু ভালো উপায় আছে। সেটা হচ্ছে ভ্যাকসিন।

চিকিৎসা

আমাদের দেশে এখন দু`ধরনের ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। একটা হচ্ছে সার্ভারিস্ক ভ্যাকসিন, অন্যটা হচ্ছে গার্ডাসিল ভ্যাকসিন। তবে এই ভ্যাকসিনগুলো এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো বিভিন্ন ভ্যাকসিন সেন্টারে টাকার বিনিময়ে দিচ্ছে।

এতে তিন- চার হাজার টাকা একজন রোগীর খরচ হয়। প্রতিটা ভ্যাকসিন তিন ডোজ করে দেওয়া হয়। এই ভ্যাকসিন নিলে নারী মোটামুটি একটা প্রোটেকশানে থাকে যে তার জরায়ুমুখে ক্যান্সার হবে না। তবে আমি যে এইচপিভি ভাইরাসের কথা বললাম তার অনেক টাইপ আছে। হাজারটা টাইপ আছে।

আমাদের যে ভ্যাকসিন তা সর্বোচ্চ চারটা টাইপের বিরুদ্ধে কাজ করে। বাকি যে টাইপগুলো আছে তার বিরুদ্ধে কিন্তু কাজ করে না। কাজেই কারো যদি এইচপিভি ভাইরাসের চারটা ধরণ ছাড়া অন্য কোন ধরণ দিয়ে আক্রমণ করে তাহলে কিন্তু ভ্যাকসিন কাজ করে না। তার মানে ভ্যাকসিন শতভাগ প্রতিরোধকারী তা কিন্তু নয়।

অর্থাৎ ভ্যাকসিন নিলে তার আর কখনো জরায়ুমুখের ক্যান্সার হবে না এমন ধারণা ঠিক নয়। যেসব ক্ষেত্রে স্বামী- স্ত্রী বা নারী পুরুষের একাধিক যৌনসঙ্গী আছে বা খুব অল্প বয়সে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাদের আমরা কনডম ব্যবহার করতে বলি। একমাত্র এই পদ্ধতির মাধ্যমেই এই ভাইরাসটাকে প্রতিরোধ করা যায়।

জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের আগ মুহুর্তে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে তাহলে লোকাল কিছু থেরাপি দিয়ে যেটাকে আমরা বলি `হট থেরাপি`।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ ওই জায়গাটাকে পুড়িয়ে জীবানুটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এটাকে `ক্রায়ো` বলে।

এছাড়া যদি ক্যান্সার হয়েই যায় সেক্ষেত্রে পুরো জরায়ুটাকে ফেলে দিতে হবে। এটা বিশেষ ধরনের জরায়ুর অপারেশন যার ফলে জরায়ু ও আশপাশের সম্ভাব্য এলাকা ফেলে দিতে হয়। শুধু অপারেশন করলেই সমাধান হয় না। পরবর্তীতে রেডিওথেরাপী দিতে হয়।

ফুল কোর্স রেডিও থেরাপি দেওয়ার পরেও কিন্তু সারাজীবন ফলোআপে থাকতে হয়। সারা জীবন কিছু পরীক্ষা নীরীক্ষা করে ছয় মাস - এক বছর পরপর ডাক্তারের কাছে আসতে হয়। একবার যদি জরায়ুর ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু সারা শরীরে এমনকী ব্রেনেও পরবর্তী প্রভাব রেখে যেতে পারে।

জরায়ুমুখের ক্যানসারটা খুব কমন ক্যান্সার। যেসব কারণে মেয়েরা এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলে এই ক্যান্সার অনেকখানি প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমি বলব, আপনারা ভ্যাকসিনটা নিয়ে ফেলুন। ভ্যাকসিন শতভাগ না হলে ৭০-৮০% কাভারেজ দেয়।

যেসব মায়েদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর, এমন মায়েদের বলি, আপনারা অন্তত প্রতি তিন বছর পরপর ভায়া টেস্ট করুন। জরায়ুর মুখ সুরক্ষিত রাখুন।

পরামর্শদাতা : কনসালটেন্ট, ইমপালস হাসপাতাল।

অা অা/ এআর


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি