ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

টিফিনের নামে খাওয়ানো হচ্ছে বিষ!: ইসরাত জাহান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:০৫, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

বাবা মায়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ সন্তান। সন্তানের সুস্থতা চায় না, এমন বাবা মা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু অামরা কী জানি অামাদের সন্তানরা স্কুলে বা বাইরে টিফিনের নামে কী খাচ্ছে। ওরা প্রতিদিন যা খাচ্ছে তা এক কথায় বিষ।

অামি নিজে এমফিলে থিসিস করেছি চাইল্ড ওবেসিটির ওপর। ওবেসিটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অামি যখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম তুলনা করলাম, তখন দেখলাম কোন জিনিশগুলো এর জন্য হ্যাম্পার করে। চাকরীজীবী মায়েদের সন্তানরা ওবেস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে ওবেস- এর পরিমাণ বেশি। কারণ, তারা খুব ভোজন রসিক। খেতে পছন্দ করে।

অামি কাজ করতে গিয়ে ২৫০ জন ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি যাদের বয়স নয় থেকে ষোল বছরের মধ্যে। এদের পরিবারের মাসিক গড় অায় নূন্যতম চল্লিশ হাজার টাকা। এখানে অামি দেখেছি ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ওবেসিটির পরিমাণ বেশি। কারণ, মেয়েরা শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন খেলাধূলা কম করে বা করে না বললেই চলে। তারা বাসায় বই পড়ে, ফেসবুকিং করে, টিভি দেখে। সেই তুলনায় ছেলেরা বাইরে অাড্ডা করে, খেলাধূলা করে, ঘোরাফেরা করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন কোন অাইটেমগুলো বাচ্চারা বেশি খাচ্ছে যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়? সেগুলো হলো বার্গার, চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চফ্রাই, নুডলস, ডোনাট, পেস্ট্রি, চিপস, কোল্ডড্রিংকস ও পিৎজা। অামাদের এই সময়ে বাবা মায়েরা এতো ব্যস্ত থাকে তাদের সন্তানের জন্য খাবার তৈরি করার সময় করে উঠতে পারে না। তারা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুপার শপ (যেমন অাগোরা) থেকে খাবার কিনে নিয়ে বাচ্চাদের হাতে তুলে দেয়। নয়তো বাচ্চারা বিভিন্ন দোকানের খাবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে।

এই খাবারগুলোতে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে তেল নিয়ে। দোকানের এসব খাবারে ভেজাল তেল দেওয়া হয়। একই তেলে বারবার একই খাবার ফ্রাই করা হয়। তেল পরিবর্তন না করে একই তেলে সারাদিন ধরে ভাজা চলতেই থাকে। তেলে যখন তাপ দেওয়া হয় তখন সেখানে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। এই ট্রান্সফ্যাট মানব শরীরে ক্যান্সার তৈরির সেল স্টিমুলেট করে। এখন গ্যাস্ট্রিকের যে সমস্যা, অালসারের যে সমস্যা, তার অধিকাংশের জন্য দায়ী বাইরের খাবার।

এসব ফাস্টফুড অাইটেমে যে লবণটা দেওয়া হয় সেটা হলো টেস্টিংসল্ট। টেস্টিং সল্টের রাসায়নিক নাম মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। অান্তর্জাতিক বাজারে এই জিনিশটা ব্যান্ড। অামাদের দেশে কোন কোন কোম্পানি বলছে, অামরা মাত্রা অনুযায়ী টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করছি। কিন্তু অামি বলব, বিষ সব সময়ই বিষ। বেশি হলে যেমন বিষ, কম হলেও বিষ। বেশি খেলে সঙ্গে সঙ্গে ক্রিয়া করবে অার অল্প খেলে স্লো পয়জনিং হবে।

না বললেই নয়, টেস্টিং সল্ট এমন একটা জিনিশ যার কোন পুষ্টিগুণ নেই। শুধু মুখের স্বাদ বাড়ায় মাত্র। নিয়মিত টেস্টিং সল্ট ব্যবহারকারীদের মধ্যে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, হরমোন নিঃসরণে গোলযোগ, মনোবৈকল্য, শিশুদের ক্ষেত্রে লেখাপড়ায় কম মনোযোগ. অতিরিক্ত ছটফটানিভাব, হাঠৎ ক্ষেপে যাওয়া, মুটিয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। বড়দের মধ্যে অ্যাজমায় আক্রান্তরা টেস্টিং সল্ট খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া এটি মস্তিস্কে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।

টেস্টিং সল্ট বা মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট যেসব খাবারে দেওয়া হয়, তা খেলে অামাদের নার্ভকে স্টিমুলেট করে। ফলে যারা নিয়মিত চিপস খায় বা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয়েছে এমন খাবার খায় সেসব বাচ্চারা সব সময় মানসিক ভাবে উত্তেজিত থাকে। রাগী ও মেজাজী হয়। তারা সবসময় লাফালাফি করে। স্কুলে বা বাসায় কারো কথা শুনতে চায় না। অস্থির চঞ্চল থাকে। যদি মা প্রেগন্যান্সি অবস্থায় চিপস খাওয়ার প্রবনতা থাকে সেক্ষেত্রে বাচ্চার নিউরো ডিজঅর্ডার পর্যন্ত হতে পারে।

`তেল` ও `টেস্টিং সল্ট` অাইটেম দুটি ভয়াবহ। কারণ, এগুলোর বিকল্প অন্য কিছু নেই। মাছের পরিবর্তে মাংস রান্না করা যায়। অাটার পরিবর্তে ময়দা ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু তেল ও টেস্টিং সল্টের পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করার সুযোগ নেই। তাই অামাদের একটা বিষয় নিশ্চিত থাকা দরকার। সেটা হলো বাচ্চার টিফিনে যেন ক্ষতিকর তেল ও টেস্টিং সল্ট না থাকে।

যেসব বাচ্চা নিয়মিত তেল ও টেস্টিং সল্ট দিয়ে প্রস্তুতকৃত খাবার নিয়মিত খায় তারা পূর্ণ বয়সে বিভিন্ন রকম শারীরীক সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। এখন দেখবেন, অনেকে খুব কম বয়সে প্রেসারের ওষুধ খায়। তারা হাইপার টেনশানে ভোগে। একটা সময় ছিল যখন চল্লিশ বছরের অাগে কেউ প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। এখন বিশ- বাইশ বছর বয়সেও অনেকে উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। এটার জন্য দায়ী ফুড হ্যাবিট। এসব বাচ্চারা ওবেসিটিতে ভোগার সম্ভাবনা খুব বেশী। অামরা জানি, ওবেসিটি অনেকগুলো রোগের প্রধান কারণ।
হৃদরোগ হওয়া, হার্টে ব্লক ধরা পড়া, স্ট্রোক করার জন্য এসব খাবার দায়ী।

তাই সচেতন বাবা মায়ের উচিৎ, ছেলেমেয়েরা কী খাচ্ছে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা। জীবন একটাই। এই জীবনে নিজের ও সন্তানের সুস্থতার বিকল্প নাই।


লেখক: ক্লিনিক্যাল ডায়াটেশিয়ান ও নিউট্রিশিয়ানিস্ট, বিঅারবি হাসপাতাল।
আআ/এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি