ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

লিভারের অচেনা শত্রু ফ্যাটি লিভার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪৩, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১২:৩৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

ফ্যাটি লিভার লিভারের একটি খুব কমন রোগ।এরোগের কথা প্রথম শোনা যায় ১৯৬২ সালে। তবে ১৯৮০ সালে লুডউইগ প্রথম এ রোগটিকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন। ফ্যাটি লিভারের ব্যাপ্তি ব্যাপক। লিভারে সাধারণ চর্বি জমা থেকে শুরু করে ফ্যাটি লিভারের কারণে এসব রোগীদের লিভার সিরোসিস, আর এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। ইদানিং কালে গবেষণাগুলোতে দেখা যায় যেসব লিভার সিরোসিস রোগীদের রোগের মুল কারণটা খুজে পাওয়া যায় না, তাদের অনেকেই আসলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

যেসব কারণে ফ্যাটি লিভার হয়-
পাশ্চাত্যে ফ্যাটি লিভারের মুল কারণ এ্যলকোহল। তবে আমাদের মতো দেশগুলোতে মেদ-ভুরি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ আর হাইপোথাইরয়েডিজমই ফ্যাটি লিভারের মুল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি খুবই বেশী। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৩% ডায়াবেটিস রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে ৪৯% ভারতীয় যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আনেক সময়ই ফ্যাটি লিভার করে থাকে।

কর্টিকোস্টেরয়েড, টেমোক্সিফেন ইত্যাদি ঔষধ দীর্ঘদিন সেবনেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে। ফ্যাটি লিভারের আরেকটি বড় কারণ খাদ্যাভাস ও লাইফ স্টাইল। সিডেন্টারি বা আয়েশি জীবন-যাপন আর অতিরিক্ত ফ্যাট বা কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খেলে লিভারে চর্বি জমতেই পারে। আমাদের দেশে ইদানিংকার খুবই জনপ্রিয় ’ফাস্ট-ফুড’ কালচার এদেশে ফ্যাটি লিভারের বাড়তি প্রাদুর্ভাবের সম্ভবত একটি বড় কারণ।

ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব
ফ্যাটি লিভার রোগটি বিশ্বজনীন।সারা বিশ্বেই এর দেখা মেলে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এর প্রাদুর্ভাব খুবই বেশি। শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ আমেরিকান এ্যডাল্ট ও ১০ ভাগ শিশু ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। জাপান ও ইটালীতে মোট জনসংখ্যার ৩০% থেকে ৫৮%-এর ফ্যাটি লিভার রয়েছে।

ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস দেখা দিতে পারে যাকে আমরা বলি স্টিয়াটো হেপাটাইটিস।পাশাপাশি এটিও এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ফ্যাটি লিভার লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। আগামী কয়েক দশকে প্রায় ২মিলিয়ন আমেরিকান ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হবে বলে এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়। প্রতিবেশী ভারতে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের শতকার ১৬ ভাগের ফ্যাটি লিভার রয়েছে।

আন্তর্জাতিক জার্নালে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী যে সমস্ত রোগীদের স্টিয়াটো হেপাটাইটিস আছে, তাদের প্রায় ৩০% এর পরবর্তী সময়ে লিভারে সিরোসিস দেখা দিতে পারে। আর এদের কেউ কেউ লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন। আমাদের দেশেও এই চিত্রটি, বিশেষ করে শহর এলাকায়, সম্ভবত খুব একটা অন্যরকম নয়। আমরাও প্রায়ই ফ্যাটি লিভারের রোগীদের দেখা পাই। আমাদের পরিচালিত গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ। একইভাবে আমাদের আরেক গবেষণায় দেখা যায় যে, এদেশে প্রায় ৪% লিভার সিরোসিস রোগী ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

ফ্যাটি লিভার থেকে একবার লিভার সিরোসিস হলে, ১৫% রোগী সাত বছরের মধ্যে আর ২৫% দশ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণের ঝুকিতে থাকেন।

রোগের লক্ষণ ও রোগ নির্র্ণয় অন্যান্য বেশিরভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মত ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোন লক্ষন থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যাথা, ভার-ভার ভাব বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পরার কথা বলে থাকেন।

শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব রোগীদের প্রায় ৫০%-এর লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশি থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই একথা বলা যায় না। ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আল্ট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটি স্ক্যান বা এমআরআই এক্ষেত্রে বেশি নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের অধিকাংশ রোগীরই রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকে।

ফ্যাটি লিভারের রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য ইদানিংকালে খুবই উপকারি পরীক্ষা হচ্ছে ফাইব্রোস্ক্যান। পরীক্ষাটি অনেকটা আল্ট্রাসনোগ্রামের মত হলেও এটি আসলে আল্ট্রাসনোগ্রাম নয়। এই মেশিনের সাহায্যে খুব সহজেই লিভারে ফাইব্রোসিস বা স্থায়ী ক্ষতির মাত্রা জানা যায়। অর্থাৎ জানা যায় লিভারে সিরোসিস হবার ঝুকি কতখানি। আর এটিই একমাত্র পরীক্ষা যা দিয়ে লিভারে চর্বির পরিমাণও পরিমাপ করা যায়।

তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষাটি হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নির্ভুলভাবে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্বন্ধেও একমাত্র এই পরীক্ষাটির মাধ্যমেই শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা
ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মুল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের ঝুকি প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার একটি অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রুত, অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে তাতে বরং হিতে-বিপরীত হওয়ার আশংকা থাকে। কারণ এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝুকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ঔষধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশন করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের কারণ নির্ণয় ও তার যথাযথ চিকিৎসাও অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।

ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা থেকে লিভারকে রক্ষা ও পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক গবেষণা চলছে। এদেশে আমরাও এ বিষয়ে সিমীত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। একথা ঠিক যে এখনও এজন্য শতভাগ কার্যকর কোন ঔষধ আবিস্কার হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশ কিছু ঔষধ আছে যা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণিত। আর এর বেশিরভাগই বাংলাদেশেও পাওয়া যায়।এসব ঔষধের মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ইনসুলিন সেন্সেটাইজারস, আরসোডিঅক্সিকলিক এসিড, প্রোবায়োটিক্স, ভিটামিন-ই, এন্টি-অক্সিডেন্ট ইত্যাদি।

শেষ কথা
একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হত হার্ট বা ব্রেনে চর্বি জমে হার্ট-এ্যাটাক বা স্ট্রোকের মত মারাত্বক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়।কিন্তু বিগত দশকে সেই ধারনার আমুল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি আজ প্রমাণিত যে ফ্যাটি লিভার, লিভারের অন্যতম প্রধান রোগ। ২০০২ সালেও যেখানে লিভার রোগের প্রধান বইগুলোতে ফ্যাটি লিভারের উপর আলাদা কোন চ্যাপ্টার ছিল না, সেখানে আজ লিভার রোগের যে কোন আন্তর্জাতিক কন্ফারেন্সে বা নামকরা জার্নালগুলোর অনেকখানিই জুড়ে থাকছে ফ্যাটি লিভার। সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ শুরুতে ব্যাবস্থা নিলে এ রোগ অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য।

লেখক: মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
চেয়ারম্যান হেপাটোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
টিআর/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি