ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শীতে প্রবীণদের নানা সমস্যা

প্রকাশিত : ১৪:৩১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৪:৩৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, ফলে বয়স্ক মানুষদের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বয়ষ্কজনিত রোগব্যধিও। এই বয়সটাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রাকৃতিগতভাবেই বিভিন্ন রকমের শারীরিক পরিবর্তনও আসে। ষড়ঋতুর এই দেশে বিভিন্ন সময়ে আবহাওয়ার আকষ্মিক পরিবর্তনের সাথে তরুণ বা মধ্যবয়সীরা খাপ খাইয়ে নিতে পারলেও বয়স্কদের বেশ ভুগতে হয়। আর শীতকালে বয়স্কদের মাঝে এর প্রকোপটা বেশ গভীরভাবেই পরিলক্ষিত হয়।এ সময় শ্বাস প্রশ্বাস,ত্বকের সমস্যাসহ নানা ধরণের অসুবিধা দেখা দেয় বয়স্কদের। তাই তাদের নেওয়া দরকার বিশেষ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা: শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা বা শ্বাসনালীর প্রদাহ বয়স্কদের খুবই কমন। এছাড়াও শীতে সাধারণ সর্দি, কাশি বা ফ্লু থেকে হতে পারে নিউমোনিয়া। যারা আগে থেকেই এজমা, ব্রংকাইটিস, সিওপিডি, এমফাইসিমা ইত্যাদি রোগে ভোগেন, শীতের সময় এসব সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এর থেকে পরিত্রানের জন্য উচিত সব সময় গরম কাপড় পরিধান করা, গরম পানি পান ও ব্যবহার করা। তায়াম্মুম করে নামাজ পড়া উচিত।

রুম গরম রাখার জন্য সম্ভব হলে রুম হিটার ব্যবহার করতে পারেন। ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঘরের বাইরে যাওয়া কোন মতেই উচিত নয়, বিশেষ করে যারা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। একান্ত প্রয়োজনে বাইরে যদি যেতেই হয়, যথেষ্ট পরিমাণ শীতের কাপড় পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। মাথার ও কানের টুপি, মাফলার, হাতে উলের গ্লাভস ব্যবহার করা উচিত। যাদের এজমা বা শ্বাসকষ্ট আছে, তারা সব সময় ইনহেলার সাথে রাখুন এবং প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করুন। খুব বেশী সমস্যা হলে ঘরে নেবুলাইজার ব্যবহার করতে পারেন, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের অধীনে চিকিত্সা নিন।

গিরায় ব্যথা বা আর্থ্রাইটিস: এ বয়সে অনেকেই অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপরোসিস বা অন্যান্য হাড় ও অস্থিসন্ধির ব্যথায় ভোগেন। এমনকি অনেকের আগে থেকেই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এলকাইলোজিং স্পন্ডডিলাইটিস, সারভাইকাল স্পন্ডইলোসিস জাতীয় রোগ থাকতে পারে। এ ধরণের রোগীদের ব্যথার সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। এর মূল কারণ শুধু শীত নয়, বরং শীতকালে কাজকর্মে, শারীরিক পরিশ্রম বা নড়াচড়া কম হয় বলে এই সমস্যাগুলো আরও বেড়ে যেতে পারে। এর থেকে মুক্তির জন্য ঠান্ডা পরিহার করা উচিত। সম্ভব হলে ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি, হাত পা নড়াচড়ার মতো হালকা ব্যায়ামের অনুশীলন করতে হবে। এতে শরীরে তাপ উত্পন্ন হবে, শীত কম লাগবে। প্রয়োজনে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।

রেনোড ফেনোমেনন: তীব্র ঠান্ডায় হাত-পা নীল হয়ে যাওয়াকে রেনোড ফেনোমেনা বলে। হাত ও পায়ের আঙুলে রক্ত সরবরাহ কম হওয়ার কারণে এমন হতে পারে। সাধারণত ধূমপায়ী ও বাত রোগীদের এটি বেশি হয়। এর ফলে ত্বকে অস্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া, রক্তপ্রবাহ সঠিকভাবে না হওয়া, হাতে ও আঙ্গুলের ব্যথা, কব্জি ফুলে যাওয়া, ত্বকের ক্ষত, মাংসপেশীতে ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি ঠান্ডায় আঙ্গুলে ইস্কিমিক আলসারও হতে পারে। একে ফ্রস্ট বাইট বলে। যাদের এই সমস্যা হয়, তাদের উচিত মোজা পরিধান করা, গরম ষেক দেওয়া, ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা ও চিকিত্সকের নির্দেশনা মতো চলা। অবশ্যই ধূমপান পরিহার করতে হবে। এসব রোগীর ঠান্ডা পানি ব্যবহার না করে, গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।

হাট এ্যাটাক ও স্ট্রোক: শীতে বয়ষ্কদের হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিটাও বেশী থাকে। কারণ শরীর থেকে গরম বের হতে পারেনা, ঠান্ডায় ধমনী সঙ্কুচিত হয়ে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। এছাড়াও রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, ফলে রক্তনালীতে রক্ত সহজেই জমাট বেধে দেখা দেয় স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাক। এর থেকে পরিত্রানের জন্য গরম কাপড় পরিধান করতে হবে, গরম পানি পান ও ব্যবহার করতে হবে। ঘরে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা অন্যান্য রোগে ভোগেন যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি, তাদের অবশ্যই এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বুকে ব্যথা অনুভব করলে তা আমলে এনে দ্রুত চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে।

হাইপোথার্মিয়া: যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়, তাকে হাইপোথার্মিয়া বলে। বয়স্কদের এই ঝুঁকিটা বেশি থাকে, বিশেষ করে শীতের সময়। হাইপোথার্মিয়া হলে বিপাকীয় কার্যাবলী স্বাভাবিক ভাবে সম্পন্ন হয় না, শরীরে কাঁপুনি হয়, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না, দিকভ্রান্ত হয়, হোঁচট খেতে থাকে, গতি ধীর হয়ে যায়, কথাবার্তা জড়িয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হূদস্পন্নদ আশংকাজনক মাত্রায় কমে যায়। কোন সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এমনকি মৃত্যুবরণও করতে পারে। এ সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য সব সময় গরম কাপড় পরিধান করতে হবে, গরম পানি পান ওজু বা গোসলের সময় অবশ্যই গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।

চর্মরোগ: শীত এলেই কিছু চর্মরোগ নতুন করে আবির্ভূত হয়, যা গরমকালে খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে চামড়ার শুষ্কতা, চুলকানি, হাত-পা ফেটে যাওয়া, মুখে ও জিহ্বায় ঘা ছাড়াও নানা ধরণের চর্মরোগ বা খোসপাঁচড়া বেশি দেখা দেয়। এছাড়া ভাইরাসের কারণে মুখে জ্বরঠোসা, ফাঙ্গাসের কারণে ত্বকে ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিস ইত্যাদি দেখা দেয়। এই সময় বয়স্কদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কেননা এসব রোগের প্রবণতা তাদের বেশি থাকে। তাদের বিছানা বা পড়নের কাপড় যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এক বিছানায় গাদাগাদি করে ঘুমানো উচিত নয়। ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার যেমন ভ্যাসলিন, স্লিসারিন, অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন। গোসলের আগে নয়, গোসলের পর গা ভেজা ভেজা থাকতেই এগুলো ব্যবহার করা ভালো। প্রয়োজনে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে পারেন।

মানসিক সমস্যা: প্রবল শীতে অনেকেরই অবসাদগ্রস্ত হয়ে বিষন্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হতে পারে, যা সাধারণত প্রবীণ বা বৃদ্ধদেরই বেশি হয়। তখন তারা সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করেন। ট্রমা ও বিষন্নতায় ভোগা এসব মানুষের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের তাদের সঙ্গে বেশি সময় দেওয়া উচিত। বিশেষ করে তাদের নিয়ে এক সঙ্গে টেলিভিশন দেখা বা গল্প করা যেতে পারে। তারা যেমন একা একা না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মোট কথা, পরিবারের সবারই উচিত তাদের উত্ফুল্ল রাখার চেষ্টা করা।

আরো কিছু পরামর্শ: - শীতে বয়স্কদের শুধু মোট কাপড় নয় বরং আরামদায়ক গরম কাপড় পড়াতে হবে। - তাদের ত্বক, ঠোট, হাত-পা, নখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন ক্রিমসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।

- সব সময় তাদের সোবার ঘরটির দিকে নজর দিতে হবে। বিছানা যেন শীতল না হয়ে যায়, ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস এবং গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝে মধ্যে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে।

- ওজু, গোসল সহ নানা কাজে গরম পানি ব্যবহার করতে হবে, যাতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে।

- ভিটামিন ডি শরীরে জন্য খুবই দরকারী, যার মূল উত্স সূর্যের আলো। এর অভাবে অস্থিসন্ধি বা বাত ব্যথা বাড়ে। তাই সম্ভব হলে বয়স্কদের প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট রোদ পোহাতে হবে।

- শীতের শাক সবজি গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি এবং খাদ্য তালিকায় ভিটামিন, মিনারেল রাখতে হবে। সব সময় গরম খাবার পরিবেশন করতে হবে। শীতের সময় রাত জাগা ক্ষতিকর। তাই দ্রুত শুয়ে পড়ার অভ্যাস এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। বয়স্কদের মদ্যপান, ধূমপান, অতিরিক্ত চা, কফি পান করা থেকে বিরত রাখতে হবে। পানি কম পান করলে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্টসহ নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এজন্য গরম পানি ও কেমিক্যালমুক্ত ফলের রস পান করতে দিন।

- শীতের সময় ডায়রিয়ার সমস্যাও বেড়ে যেতে পারে। এর থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে বাসি খাবার খাবেন না, পরিষ্কার থাকুন। ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইনসহ প্রচুর পানীয় পান করুন ও চিকিত্সকের পরামর্শ নিন।

উক্ত নিয়ম মেনে চললে শীতের সময়েও বয়স্করা অনেকটা সুস্থ থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে পরিবারের দায়িত্বটাই খুব জরুরী।

লেখক:

সাবেক ডীন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি