ঢাকা, সোমবার   ১০ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

কোভিডে লিভারের যত কথা

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

প্রকাশিত : ১৩:১৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

Ekushey Television Ltd.

এদেশে কোভিড আসার ছয় মাস পূর্তি হল এই সেপ্টেম্বরে। পৃথিবীতে কারো-কারো করোনার সাথে বসবাস একটু লম্বা আর কারো আরেকটু কম। বছর পেরোয়নি এখনও কারোর-ই, এমনকি কোভিড এর জন্ম যে চীনে, তাদেরও না। সঙ্গত কারণে প্রতিটা দিনই আমাদের জন্য কোভিডকে নতুন করে শেখার, নতুন করে জানার। কোভিড সম্পর্কে আমাদের শুরুর দিককার যে জানাশোনা তা থেকে আমরা সরে এসেছি অনেকটাই। শুরুতে মনে করা হয়েছিল কোভিড এ ভেন্টিলেটর ছাড়া মুক্তি নেই। এখন আমরা জানি মুক্তি হাই-ফ্লো-ন্যাসাল ক্যানুলায়। তেমনি আমরা জানি স্টেরয়েড, অ্যান্টিসেপ্টিক আর রক্ত তরল করার ওষুধ এর যথার্থ ব্যবহারে মানুষের প্রাণ বাঁচবে এই কোভিডের থাবা থেকে। আর এসবের তুলনায় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এর কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কম।

প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিল কোভিড শুধু ফুসফুসের রোগ। ফুসফুস ছাড়া অন্য কোন অর্গানে এটি তেমন কোন ঝামেলা করে না। পরে আমরা বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা তা না। কোভিডে কুপোকাত হতে পারে হার্ট, আর এমনকি কিডনিও। সাইটোকাইন স্টর্ম, ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্কুলার কোয়াগুলেশন বা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধার নতুন-নতুন সব তত্ত্বও আমরা জানতে পারলাম। আর এই ছয় মাসে আমরা অনেক জেনেছি, শুনেছি বলেই ছয় মাসের মাথায় এখন কোভিড চিকিৎসায় আমরা অনেক বেশি সফল।

কোভিড যদি ইতালি হয়ে না এসে সরাসরি চীন থেকে এদেশে আসতো, তাহলে চিত্রটা অনেক বেশি মারাত্মক হতে পারতো। এদেশে পরে আসায়, কোভিড এর চিকিৎসা সম্পর্কে আমরা আগেভাগে ভালোভাবে জেনেছি বলেই, আজ আমাদের দেশে কোভিড এ মৃত্যুর সংখ্যা পৃথিবীতে তলানির দিক থেকে শীর্ষে। এক সময় বলা হয়েছিল, ভেন্টিলেটর আর হাসপাতাল বেডের অভাবে বাঙালির লাশ গড়াগড়ি খাবে রাস্তায়। আর এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টো চিত্র। রোগীর অভাবে হাহাকার করছে এদেশের কোভিড হাসপাতালের বেড আর ভেন্টিলেটরগুলো।

লিভারে কোভিড সমস্যা করে কিনা, এ নিয়ে কানাঘুষা চলছিল শুরু থেকেই। কারণ বিজ্ঞানীরা ভালই জানেন যে আমাদের পিত্তনালীর যে আবরণীগুলো, সেখানে রয়েছে এসিই-২ রিসেপ্টর যা মানুষের কোষগুলোতে কোভিডের ঢোকার দরজা। শুরুর দিক থেকেই লিভারের উপর সার্স-কোভ-২-এর প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে টুকটাক বিচ্ছিন্নভাবে দুই একটা বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা আসছিল। এরই প্রেক্ষাপটে এশীয় প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের লিভার বিশেষজ্ঞদের সংগঠন এশিয়ান প্যাসিফিক এসোসিয়েশন ফর দ্যা স্টাডি অব দ্য লিভার থেকে গঠন করা হয় একটি টাস্ক ফোর্স। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করার। এই টাস্ক ফোর্সটিতে এশীয় প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের তেরটি দেশের লিভার বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন এবং প্রায় চারশ রোগীর উপর পরিচালিত যে গবেষণা তাতে আমরা দেখতে পাই যে, যাদের লিভারে তেমন বড় কোন সমস্যা নেই, তাদের লিভারে একটু-আধটু সমস্যা হতেই পারে। হালকা-পাতলা উল্টোপাল্টো হতে পারে লিভারের ফাংশনগুলো। কিন্তু রোগীরা সাধারণত কোন রকম বড় দুর্ঘটনা ছাড়াই সেরে উঠেন।

কিন্তু যাদের লিভারে বড় কোন রোগ বিশেষ করে সিরোসিস আছে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম। বিশেষ করে যে সমস্ত লিভার সিরোসিসের রোগীরা মেদবহুল বা যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে কোভিড হলে মৃত্যুর আশঙ্কা চল্লিশ শতাংশের উপর। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এখন কোভিডে মৃত্যুর হার এক দশমিক তিন থেকে এক দশমিক চার শতাংশের মধ্যে ওঠা নামা করছে, সেখানে এটি চল্লিশ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে যদি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীর কোভিড হয় এবং বিশেষ করে তাদের ডায়াবেটিস বা মেদবহুল শরীর থাকে।

আমাদের এই গবেষণা নিবন্ধটি সম্প্রতি হেপাটোলজি ইন্টারন্যাশনাল বলে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ লিভার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমরা একই ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা আসতে দেখেছি। এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হল কোভিডের চিকিৎসা নিয়ে। চিকিৎসায় যে অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, বিশেষ করে ফেভিপিরাভির এবং রেমডেসেভির, এদের বিষয়ে আমরা এখন কিছু-কিছু রিপোর্ট পাচ্ছি যে এই ওষুধগুলো লিভারে কখনো-কখনো সমস্যা তৈরি করতে পারে। আমাদের দেশেও আমরা এ ধরণের কিছু-কিছু অভিজ্ঞতার কথা শুনছি। তার মানে এই না যে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদেরকে এ ধরনের অ্যান্টিভাইরাল দিয়ে চিকিৎসা করা যাবে না। চিকিৎসা করা যেতেই পারে, তবে রোগীর যদি বিশেষ করে আন্ডারলাইং (গোপনে বা আগে শনাক্ত না হওয়া) কোনও লিভার রোগ থাকে তবে সেসব রোগীদের ক্ষেত্রে এধরনের ওষুধ ব্যবহারের সময় একটু সতর্কতা মাথায় রাখতে হবে।

মোট কথা কোভিডে শরীরের আর দশটা অঙ্গের মতো লিভারও নিরাপদ নয়। তাই বিশেষ করে যাদের লিভারে জটিল রোগ আছে তাদের কোভিড থেকে বেচে থাকার ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আর দশ জনের সাবধানতা আর তাদের সাবধানতা একরকম নয়। কারণ কোভিড হলে তাদের ঝুকিটা অনেক বেশি। আর যদি কোভিড হয়েই যায়, বিশেষ করে তাদের উচিত হবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া এবং অবশ্যই একজন লিভার বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ রেখে চিকিৎসাটা চালিয়ে নেওয়া।

লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

এমবি//
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি