ঢাকা, বুধবার   ০২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করুন

ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন

প্রকাশিত : ১২:১০, ২৭ নভেম্বর ২০২০

Ekushey Television Ltd.

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে আবিষ্কার হয়েছিল অ্যান্টিবায়োটিক। জীবাণুনাশক ওষুধকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট বলা হয়। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক একটি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে প্রথম আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়েটিক, পেনিসিলিন আবিষ্কারের ১০ বছরেরও কম সময়ে, এমনকি স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য পাওয়া নোবেল পুরস্কার গ্রহণের আগেই এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া হয়ে ওঠে, যা পেনিসিলিন প্রতিরোধী। 

সেই থেকে গত ৭০ বছর ধরে ব্যাকটেরিয়া আর মানুষে চলছে ‘ইঁদুর-বেড়াল খেলা’। আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন প্রজন্মের নতুন প্রজাতির অ্যান্টিবায়োটিক। তার সঙ্গে তাল রেখে ব্যাকটেরিয়াও গড়ে তোলে নতুন নতুন প্রতিরোধী ক্ষমতা।

অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা অথবা প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করা ব্যাকটেরিয়ার একটি সহজাত প্রক্রিয়া। এটি মূলত শুরু হয় ব্যাকটেরিয়ার জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। এটি তখনই ঘটে যখন কোনো এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া কোনো এক সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মুখীন হয়। অ্যান্টিবায়োটিক থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যাকটেরিয়া হয় নিজেদের কোনোভাবে পাল্টে ফেলে, অথবা এমন সব রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিককে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায়।

যদিও এটা অবধারিত যে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে এর বিরুদ্ধে একসময় না একসময় প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবেই। কিন্তু আমাদের অসচেতনতা, স্বভাব এবং অবহেলার কারণে এসব প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার গুণ দ্রুতগতিতে।

গেল সপ্তাহ পালিত হয়েছে  অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ। এবারের লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদ প্রাণীজ খাদ্যে, মানবদেহে  এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষকে সচেতন করা।

আমরা না জেনে, না বুঝে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছি, এমনকি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। ডাক্তাররাও প্রায়শই যথাযথ ল্যাব টেস্ট না করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছেন অবলীলায়। ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে রোগের প্রকৃত কারণ বের না করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন দিলে তাতে চিকিৎসায় ভুল হওয়ার অনেক বেশি আশঙ্কা থাকে। আর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ না করা। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে সহযোগিতা করে এবং পরবর্তীতে বেশি মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলেও তাতে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই অ্যান্টিবায়োটিকের সুপারিশকৃত ডোজ সম্পূর্ণ করা উচিত যাতে ব্যাকটেরিয়া সহজে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে না পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ব্যতীত আরও যেসব দৈনন্দিন চর্চা অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তৃতিতে সহায়ক তা হল, ল্যাব টেস্টিং এবং মনিটরিংয়ের অভাব। হাসপাতালে বা নিজের বাড়িতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, রোগ সংক্ৰমণে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ঘন ঘন হাত না ধোয়ার অভ্যাস, হাত ধুতে সাবানের ব্যবহার না করা, ঠিকভাবে হাত ধুতে না জানা, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বছরে দুই লক্ষাধিক, যার মধ্যে ২৩ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। বিশ্বজুড়ে সাত লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে একই কারণে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এখনই সাবধান না হলে ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে প্রতি বছর এক কোটির বেশি লোক মারা যাবে এবং ১০০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সীমিত গবেষণাপত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যার মধ্যে বহু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগ রয়েছে। 

শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির আইসিইউতেই শতকরা ২৫ ভাগ ব্যাকটেরিয়া হল সুপারবাগ, যা কিনা সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী। এসব তথ্য নিঃসন্দেহে প্রকৃত চিত্রের খুব সামান্য প্রকাশ, কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই এর সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিকভাবে। সত্যি বলতে কী, কোনো এক দেশ এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কেননা উন্নত যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ এখন একই সূত্রে বাঁধা। 

দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যতই নিশ্ছিদ্র হোক না কেন, সাদা চোখে অদৃশ্য, এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুপারবাগের প্রবেশ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এর প্রমাণ হল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যেখান থেকে কোনো না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। সুপারবাগ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে এখনই তাই যুদ্ধ ঘোষণার সর্বশেষ সময়।

এ যুদ্ধ কোনো সুনির্দিষ্ট পেশাজীবীদের নয়। এ যুদ্ধে সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, গণমাধ্যম, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, বিজ্ঞানী এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবসহ সবারই কিছু না কিছু করার আছে।

আশার কথা হল, সম্প্রতি জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে লড়তে একমত হয়েছে এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  এ  কমিটির কো-চেয়ার মনোনীত হয়েছেন, এর সাফল্যের মুখ দেখতে জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজন এর যথাযথ প্রয়োগ।

আসুন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমাই। একটি প্রশ্ন মনে দাগ কাটে.. সুপারবাগ বনাম মানুষ–এ লড়াইয়ে মানুষ জিততে পারবে কি?
লেখক : নার্স ও পুষ্টিবিদ, কক্সবাজার
syedahmedtanshiruddin@gmail.com
এআই/এসএ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি