টেনশনে বাড়ে হৃদরোগের ঝুঁকি
প্রকাশিত : ২১:৪৭, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ২১:৫১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
করোনারি হৃদরোগের কারণগুলো সম্বন্ধে আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি। এখন এর বাইরে হৃদরোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণকে আমরা জানতে চেষ্টা করব। গত কয়েক দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, হৃদরোগের অন্যতম কারণ মানসিক। আর এর নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা আছে যার, তা হলো ক্রমাগত টেনশন ও স্ট্রেস।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বের সাথে মনোযোগ দিচ্ছেন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের আধিক্য কিংবা ধূমপানের অভ্যাস না থাকা সত্ত্বেও শুধু স্ট্রেসের কারণেই একজন মানুষ করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
গবেষকদের মতে, ধমনীতে কোলেস্টেরল জমে ব্লকেজ সৃষ্টি হলেই যে শুধু হার্ট অ্যাটাক হবে তা নয়। কোরিয়ার যুদ্ধের সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সে-সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের নিয়মিত অটোপসি (Autopsy) করা হতো। চিকিৎসকেরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, নিহত তরুণ সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই করোনারি ধমনী কোলেস্টেরল জমে বন্ধ হয়ে আসছিল (Advanced Stage of Atherosclerosis)। এদের মধ্যে ১৯ বছর বয়সী তরুণ সৈনিকও ছিল।
তখন প্রশ্ন উঠল, কোলেস্টেরল জমে ধমনীতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়াই যদি হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়, তবে এসব তরুণ সৈনিকের মৃত্যু তো গুলির আঘাতে নয়; বরং যুদ্ধে আসার আগে বাড়িতে বসে হার্ট অ্যাটাকে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ধমনীতে এই পরিমাণ ব্লকেজ নিয়েও তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে!
শুধু তা-ই নয়, দেখা গেছে, ধমনীতে ৮৫% ব্লকেজ নিয়ে একজন মানুষ ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে, ধমনীতে কোনো ব্লকেজ নেই কিন্তু হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। কেন?
টেনশন হৃদযন্ত্রের আসল শত্রু:
অনেক রোগী বলেন, সারাজীবন নিয়ম মেনে চলেছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছি, কোলেস্টেরলের পরিমাণও ছিল স্বাভাবিক, আমার কেন হার্ট অ্যাটাক হলো? কিন্তু তার কেস-হিস্ট্রি অর্থাৎ পারিবারিক সামাজিক পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়, তবে হয়তো দেখা যাবে, বরাবরই তিনি টেনশন বা স্ট্রেসে ছিলেন। কিংবা দৈনন্দিন ছোটখাটো সব ব্যাপারে তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তা করতেন। আসলে আধুনিক পুঁজিবাদী ভোগসর্বস্ব সভ্যতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই টেনশন।
আমরা মানুষ। সমাজে বাস করি। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আমাদের পরিবার। এ-ছাড়াও আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী, বন্ধুদের নিয়ে আমাদের বৃহত্তর পরিবার। জীবনে চলার পথে নানা ঘটনার আবেগীয় প্রতিক্রিয়ায় আমাদের ভেতরে জমা হয় বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি। কখনো-বা এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে স্ট্রেস। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেখা যায়, আমরা কেউ খুব সহজেই এসবের সাথে মানিয়ে নিতে পারি, অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু ভুলে যেতে পারি; কিন্তু অনেকে আবার এটা পারেন না। ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় তিনি একসময় বিষণ্নতা ও হতাশায় আক্রান্ত হন। আসলে সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন ক্রমাগত স্ট্রেস জীবনের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে। হৃদয়ের পাশাপাশি তখন আক্রান্ত হয় হৃদযন্ত্রও, যার অন্যতম পরিণতি করোনারি হৃদরোগ এবং অন্যান্য মনোদৈহিক রোগ। মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন—হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ মানসিক।
অনেকে মনে করেন, এনজিওগ্রামে ব্লক ধরা পড়েছে, এখন স্টেন্ট বা রিং লাগিয়ে নিলে কিংবা বাইপাস অপারেশন করে নিলেই হবে। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আর নেই। কিন্তু সত্য হলো, স্ট্রেস বা টেনশনের বৃত্ত থেকে যদি একজন মানুষ বেরিয়ে আসতে না পারেন, তবে হৃদরোগের ঝুঁকিমুক্ত থাকা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তার হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়, আর্টারিতে যে কয়টা স্টেন্টই লাগানো হোক।
যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানী মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং রে রোজেনম্যান দীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণ করেন, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি। যার ফলাফল টেনশন।
কেন এই টেনশন:
টেনশনের প্রথম কারণ আগ্রাসী পণ্যদাসত্ব বা হাইপার-কনজ্যুমারিজম। বিশ্বজুড়ে যা এখন পরিণত হয়েছে রীতিমতো এক ব্যাধিতে। এর প্রভাবে আমরা প্রতিনিয়ত কিনেই চলেছি, প্রয়োজন থাকুক আর না-ই থাকুক। যত কিনছি তত বাড়ছে অভাববোধ, অতৃপ্তি। সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের অশান্তি। কারণ বস্তু কখনো শান্তি দিতে পারে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা শতকরা ৮০ ভাগ কেনাকাটাই করি আবেগে। যাকে বলে চোখের ক্ষুধা। যেমন : আপনার আইসক্রিম খাওয়ার কথা মনেও হয় নি, কিন্তু একজনকে খেতে দেখলেন, অমনি আপনারও মনে হলো—আহা! আমিও একটা আইসক্রিম খাই! এই ক্ষুধাটা হচ্ছে চোখের ক্ষুধা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আবেগের বশবর্তী হয়ে এই ৮০ শতাংশ কেনাকাটা না করলেও মানুষ খুব সুন্দরভাবে তার জীবনধারণ করতে পারে।
পণ্যদাসত্ব কেবল অশান্তির মাত্রাই বাড়ায়। আমেরিকানদের কথাই ধরুন, জনসংখ্যার দিক থেকে তারা পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ, আর পৃথিবীর মোট সম্পদের ৫৫ শতাংশের মালিক তারা। কিন্তু তারপরও তাদের জীবনে কি শান্তি আছে? ট্র্র্যাঙ্কুইলাইজার যে দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ অশান্তি ওখানেই সবচেয়ে বেশি।
আপনি ভাবলেন, একটা বাড়ি থাকলে ভালো হতো। অনেক কষ্টে বানালেন একটা বাড়ি। কিছুদিন পর ভাবলেন, একটা ফ্ল্যাট না থাকলে কেমন হয়? শুরু হলো ফ্ল্যাটের জন্যে ছোটাছুটি। যত কিনছেন, অভাব বাড়ছেই। কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতা—এ জগতে, হায়, সে-ই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি—/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
এ যুগে কাঙালের ধন কীভাবে চুরি করা হয়? তাকে কিনতে অভ্যস্ত করে। যত সে কিনবে, তত বাড়তে থাকবে পুঁজিপতিদের সম্পদ। সেই টাকা থেকেই তারা আবার ঋণ দেয় সাধারণ মানুষকে, যাতে সে আরো কিনতে পারে। এভাবে কিনতে কিনতে সে একসময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আক্ষরিক অর্থেই সে তখন হয়ে ওঠে পণ্যদাস। যত সে কিনছে, পরিণামে বাড়ছে অশান্তি। সেইসাথে বাড়ছে টেনশন।
অসুস্থ বিনোদন:
মানুষ যখন কোনো কারণে একঘেয়েমিতে ভোগে, তখন এ থেকে মুক্তির জন্যে সে বিনোদন খোঁজে। একটা সময় এই বিনোদন মানে ছিল বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা—ফুটবল ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন টেবিল-টেনিস ক্যারম দাবা লুডু ইত্যাদি। সেইসাথে একটু গল্পগুজব, বেড়ানো ও কদাচিৎ নাটক-সিনেমা দেখা। সময়ের হাত ধরে আজ বিনোদনের ধরন বদলে গেছে। খেলাধুলা, গল্পগুজব, বেড়ানোর জায়গা দখল করে নিয়েছে টিভি ইন্টারনেট ফেসবুক টুইটার স্মার্টফোন। দিনরাতের বড় একটা অংশই দখল করে নিয়েছে ভার্চুয়াল জগৎ। আর এই অসুস্থ বিনোদনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদের বাস্তব জীবনে। টিভি সিরিয়ালের মূল বিষয় কূটনামি গীবত পরচর্চা ভায়োলেন্স ষড়যন্ত্র ও পরকীয়া। এসবের কুপ্রভাবও বিষিয়ে তুলছে আমাদের জীবন। এ-ছাড়া ফেসবুকের মরণ ছোবল পড়ছে আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে, আমাদের নৈতিকতায়। ফলে হু হু করে বাড়ছে দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, বিবাহবিচ্ছেদ, খুন, শিশু ও নারী নির্যাতন। বাড়ছে স্ট্রেস।
কিভাবে টেনশন থেকে মুক্তি মিলবে?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগেও টেনশনমুক্তির জন্যে কার্যকরী কোনো ওষুধ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন নি বিজ্ঞানীরা। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো সম্বন্ধে যারা সচেতন তারা জানেন—কার্যকরভাবে টেনশন দূর করার বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে শিথিলায়ন বা রিল্যাক্সেশন। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ বিষয়টি আজ প্রমাণিত সত্য।
আমরা জেনেছি, টেনশন বা স্ট্রেসের ফলে শরীরের সব ¯স্নায়ুু, পেশি, কোষ উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং পুরো শরীরে সৃষ্টি হয় ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স। অন্যদিকে শিথিলায়নে দেহের প্রতিটি কোষকে শিথিল করা হয়, বলা যেতে পারে শুইয়ে দেয়া হয়। শিথিলায়নকালে দেহের প্রতিটি কোষ পায় ব্যক্তির মমতাপূর্ণ নিবিড় মনোযোগ।
শিথিলায়নকালে একজন মানুষ তার মনের গভীরে প্রবেশ করে। মন প্রশান্ত হয়। তখন ব্রেন থাকে সবচেয়ে কার্যকর অবস্থায় অর্থাৎ আলফা লেভেলে। শিথিলায়নে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি হয়। নিয়মিত শিথিলায়নে মনে প্রশান্তি আসে, ফলে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো তখন মনকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করে। আর দুশ্চিন্তা ও শিথিলায়ন একসাথে সম্ভব নয়। কারণ শরীর শিথিল হলে দেহ-মনে কখনো টেনশন বা দুশ্চিন্তা থাকে না।
নিয়মিত শিথিলায়ন চর্চা:
নিয়মিত শিথিলায়ন চর্চায় মনের নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক আবেগ ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে থাকে। প্রফেসর ডা. হার্বার্ট বেনসন দীর্ঘ গবেষণার পর প্রমাণ করেছেন, গভীর শিথিলায়নে হার্টবিট কমে। দেহে ব্যথা বা আঘাতের অনুভূতি হ্রাস পায়, উচ্চ রক্তচাপ কমে। দমের গতি ধীর হয়ে আসে। রক্তে ল্যাকটেট ও এড্রিনালিনের পরিমাণ হ্রাস পায়। প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের তৎপরতা বাড়ে। দেহকোষে অক্সিজেন গ্রহণের চাহিদা কমে। সেইসাথে বাড়ে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শরীর আপনা থেকেই রোগমুক্তির প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে।
বলা যায়, শিথিলায়নের আনন্দই আলাদা। শরীর-মনে এটি অনাবিল সুখ ও আনন্দ-অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাই শিথিলায়নের প্রাথমিক প্রাপ্তি হচ্ছে প্রশান্তি। আপনি যত শিথিলায়নের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন তত প্রশান্তিতে অবগাহন করবেন। শিথিলায়ন হলো মন নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত মেডিটেশনের প্রথম স্তর।
শিথিলায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন—সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড। লেখক : মহাজাতক। প্রকাশক : সেবা প্রকাশনী।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
আরকে//