মানসিক রোগে লুকোছাপা নয়
প্রকাশিত : ১৮:২৪, ১২ জানুয়ারি ২০২৩
বিশ্বের ১৩ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার ১৮.৫ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বিষণ্নতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা American Psychiatric Association ৯টি লক্ষণ উল্লেখ করেছে, যার অন্তত ৫টি টানা দু'সপ্তাহ বা তার বেশি সময় থাকলে তা বিষণ্ণতা হিসেবে গণ্য হবে। দেশে মানসিক রোগীদের ৯২ শতাংশই কোনো চিকিৎসা নেয় না বা পায় না। লঘু ও মাঝারি মাত্রার মানসিক রোগ কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপিতেই নিরাময় হয়। বাকিদের ক্ষেত্রে ওষুধ লাগতে পারে।
একবিংশ শতকে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মানসিক রোগ। singlecare.com এর Mental Health Statistics 2021 মোতাবেক বিশ্বের ১৩ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। বাংলাদেশও এ-ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তবে অনেকেই মানসিক রোগকে 'রোগ' মনে না করে জ্বীন-ভুতের আছর, জাদুটোনা বা পাপের ফল মনে করেন। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বদলে পান অবহেলা, পরিণত হন হাসি-ঠাট্টা বা উপহাসের পাত্রে। যে রোগ সহজেই নিরাময় হতে পারতো পরিণামে সেটাই পরিণত হয় দুরারোগ্য ব্যধিতে।
মানসিক রোগ আসলে কী?
মানসিক রোগী- কথাটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে উষ্কখুষ্ক চেহারার কোনো মানুষ, যার পোষাক-আশাকের ঠিক নেই। যে বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলে, অযথাই হাসে কিংবা কাঁদে। মানুষ দেখলে তেড়ে মারতে আসে। প্রকৃতপক্ষে মানসিক রোগীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এরা। অনেক রোগীই তাদের অসুস্থতা প্রকাশ পেতে দেন না; ফলে তাদের মনোজগতে কী তোলপাড় চলছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝা মুশকিল। আসলে দৈহিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও আমাদের জীবনের অংশ। চিন্তা, আবেগ, আচরণ, স্মৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ইত্যাদি হলো মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ। কোনো কারণে এর এক বা একাধিক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষুণ্ণ হয় ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য। পরিণামে তিনি সামাজিক, পেশা বা পারিবারিক জীবনযাপনে সমস্যার সম্মুখীন হন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোরোগবিদেরা মোটাদাগে ২ ধরণের মানসিক অসুস্থতার কথা বলেন। সাধারণ (minor) এবং গুরুতর (major)।
সাধারণ মানসিক অসুস্থতার মধ্যে আছে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, Obsessive Compulsive Disorder (OCD) বা শুচিবায়ু, ফোবিয়া বা ভীতি ও বিষণ্ণতা। অন্যদিকে, গুরুতর মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছে- সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজ-অর্ডার, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতা, আলঝেইমার ইত্যাদি। সবচেয়ে কমন মানসিক রোগ হলো ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণামতে ২০৩০ নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বিষণ্নতা। গবেষক ও চিকিৎসকরা মনে করেন, সাধারণভাবে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় কখনো না কখনো বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। WHO-র ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের ফ্যাক্ট শিট অনুযায়ী বিশ্বের ৩.৮ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে, সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় ২৮ কোটি! তবে বিষণ্নতাকে অনেকেই সাধারণ মন খারাপের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। আসলে প্রাত্যহিক জীবনে আবেগিক নানা টানাপোড়েনের কারণে মন খারাপ আর দিনের পর দিন মন খারাপ থাকা এক নয়। বিষণ্নতা একজন মানুষকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, কমিয়ে দিতে পারে তার শিক্ষাগত, পেশাগত, পারিবারিক ও সামাজিক কর্মতৎপরতা। এমনকি ঠেলে দিতে পারে আত্মহত্যার দিকেও। অথচ কাছের মানুষেরাও বুঝতে পারে না কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন।
একটি ঘটনা, এক সন্তানের জননী সামিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম)। ২০১৯ সালে হঠাৎই একদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে বসেন। তিনি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন, যা আপনজনেরা প্রথম জানতে পারে সেই ঘটনার পর। অথচ আত্মহত্যা চেষ্টার একদিন আগেও তিনি কাজিনদের গ্রুপ নিয়ে ঘুরে এসেছেন! গণমাধ্যমে আমরা হরহামেশাই মেধাবী তরুণদের ঝরে পড়ার যে দুঃখজনক ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হই তার নেপথ্যে থাকে মনের জমানো অব্যক্ত বেদনা, কোনো পোস্টমর্টেমই যার খোঁজ দিতে পারে না।
মনখারাপ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা; জীবনের পথে চলতে গিয়ে আমরা কম-বেশি এর শিকার হই। সেটা বেশিক্ষণ থাকেও না। সময়ের প্রবাহে অথবা ভালো কোনো ঘটনায় মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যদি টানা মনখারাপ ভাব থাকে এবং যতই ভালো ঘটনা ঘটুক বা প্রিয় জায়গায় যাওয়া হোক, মন খারাপ ভাবের পরিবর্তন হয় না, তখন সেটা মানসিক রোগের উপসর্গ বলে ধরে নিতে হবে। APA বিষণ্ণতার ৯টি লক্ষণ উল্লেখ করে বলেছে, কারো মধ্যে এর অন্তত ৫টি টানা দু সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় দেখা গেলে সেটি বিষণ্ণতা হতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা পছন্দের কাজগুলোতেও আনন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া ঘুম অস্বাভাবিকভাবে কম বা বেশি হওয়া খাবারে অরুচি কমা বা বেড়ে যাওয়া ওজন কমে যাওয়া কাজে ও চিন্তায় ধীরগতি হয়ে যাওয়া নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা সবকিছুতে নিজেকে দায়ী মনে করা সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা বা চেষ্টা করা।
মৃদু বিষণ্নতা আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যায়। এ-ক্ষেত্রে কারও সাথে শেয়ার করলে বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ালে উপকার পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বিচ্ছিন্ন না থাকা, সবার সঙ্গে মেশা। যাদের সঙ্গ ভালো লাগে তাদের কাছে থাকা। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ। আরেকটা ভালো উপায় হলো শরীরচর্চা করা। নিয়মিত ইয়োগার পাশাপাশি প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা। সেই সাথে দুই বেলা মেডিটেশন। তবে আপনি যদি কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান তাহলে তার পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন বাদ দেবেন না।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে ফেলে। কখনো কখনো অডাটরি (শ্রবণ-সংক্রান্ত) হেলুসিনেশনে ভোগে। মানে তারা গায়েবি আদেশ-নির্দেশ শুনতে পান বলে শ্রুতিভ্রম হয়। বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে তারা পার্থক্য করতে পারে না। স্মৃতিশক্তি ও স্বত:স্ফূর্ততাও কমে যেতে থাকে। অন্যদিকে, বাইপোলার ডিজঅর্ডার হচ্ছে দুটো অস্বাভাবিকতা বা দু ধরনের মানসিক রোগের একটা মিশ্রণ। বলা যায় মনের দুই মেরুতে বিচরণ। একটি মেরু হচ্ছে মেজাজ বা মুড খুব ভালো থাকা। যথেষ্ট কারণ ছাড়াই চরম উৎফুল্ল উল্লাসিত থাকা। আর দ্বিতীয় মেরু হলো বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হওয়া। এবং সেটাও যথেষ্ট কারণ ছাড়াই। এই উৎফুল্লতা এবং বিষণ্নতা, এগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে চলতে থাকে। দেখা যাচ্ছে দুই/তিন সপ্তাহ এদের মধ্যে এত বেশি কর্মোদ্দীপনা ও কর্মচাঞ্চল্য যে ঘুমাতে পারছে না, খেতে পারছে না। সারাদিন পরিকল্পনা করছে বা বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে ডুবে থাকছে। আবার দেখা যাচ্ছে ডিপ্রেসিভ মুড যখন চলে আসে তখন রোগী সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কারো সাথে কথাবার্তা বলে না। নিজেকে পুরোপুরি নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়।
চিকিৎসা কী?
মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রধান ৩টি পদ্ধতি হচ্ছে- ১. ফার্মাকোথেরাপি বা ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা ২. সাইকোথেরাপি- ওষুধবিহীন সাইকোলজিকেল পদ্ধতি, যেখানে একজন সাইকোথেরাপিস্ট মূলত কথার মাধ্যমে রোগীকে তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেন। কথোপকথনের মধ্য দিয়ে রোগী নিজেই নিজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন ৩. কম্বিনেশন থেরাপি- ফার্মাকোথেরাপি এবং সাইকোথেরাপির সম্মিলিত প্রয়োগ।
কার ক্ষেত্রে কোনটি প্রযোজ্য?
সিজোফ্রেনিয়াসহ গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে নিজের রোগের ব্যাপারে রোগীর কোন Insight থাকে না। অর্থাৎ তার কোনো মানসিক ব্যাধি আছে এটা সে স্বীকার করেন না বা মানতে চায় না। Anti-psychotic ওষুধের মাধ্যমে যখন আরোগ্য লাভ করতে থাকে তখন তার Insight ফিরে আসে। অর্থাৎ সে বুঝতে পারে যে, সে মানসিক রোগী এবং এ জন্য তার চিকিৎসা প্রয়োজন। অন্যদিকে, সাধারণ (Minor) মানসিক রোগের ক্ষেত্রে রোগী বুঝতে পারে যে তার মানসিক কোনো সমস্যা হচ্ছে। সাইকোথেরাপি প্রয়োগে সে সেরে উঠতে পারে। রোগের তীব্রতার ওপরও চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগ নির্ভর করে রোগের তীব্রতার ওপর।
সাধারণ মানসিক ব্যাধিকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়- লঘু (Mild), মাঝারি (Moderate) ও তীব্র (Severe)। Mild এবং কখনও কখনও Moderate রোগগুলোতে সাইকোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়। তবে Severe অসুস্থতার ক্ষেত্রে কম্বিনেশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ, ওষুধ প্রয়োগ করে রোগের লক্ষণগুলোর তীব্রতা কমিয়ে এনে পরবর্তীতে সাইকোথেরাপি দেয়া হয়। কাজেই যে-কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রথমে রোগটি নির্ণয় করবেন এবং সিদ্ধান্ত নেবেন রোগীর কোন ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন।
দেহের রোগের মতো মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও সুচিকিৎসা জরুরি বলে মনে করছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এদের ৯২ শতাংশই কোনো চিকিৎসা নেয় না মূলত অসচেতনতা ও লোকলজ্জার ভয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পেলে সেরে ওঠেন। আর এ-কাজে তাকে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় সহযোগিতাটা করতে পারে তার পরিবার বা বন্ধুরাই। কারণ দৈহিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি নিজের নিরাময়ের দায়িত্ব নিজে নিতে পারলেও মানসিক রোগের ক্ষেত্রে তা সেভাবে পারে না। এমনকি সে যে রোগগ্রস্ত সেটাই হয়তো তার অজানা। তাই প্রয়োজন রোগের পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি। প্রিয়জন শারীরিকভাবে অক্ষম হলে আমরা যেমন লোকলজ্জায় না ভুগে তার চিকিৎসার ব্যাপারে তৎপর হই, তেমনি মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও বিষয়টাকে সহজভাবে গ্রহণ করে সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিন। আপনার একটু সহনশীলতা, মমতা আর সমমর্মিতা পেলেই সে ফিরে পাবে সুস্থতা ও স্বাভাবিক জীবন।
এমএম/