ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

উচ্চ রক্তচাপ: ওষুধ ছাড়াই নিরাময়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৪০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কয়েক দশক ধরেই বিশ্বজুড়ে অন্যতম ঘাতক ব্যাধি-উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন), যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতাসহ জীবনঘাতী নানা রোগের সূত্রপাত করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি তিন জনে একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ সংখ্যা প্রতি পাঁচ জনে একজন।

রক্তচাপ

আমাদের দেহে ছড়িয়ে আছে জালিকার মতো অসংখ্য রক্তনালী। শিরা ধমনী মিলিয়ে যার দৈর্ঘ্য ৬০ হাজার মাইল। রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় এই সকল রক্তনালীর গায়ে যে চাপ পড়ে, তা-ই রক্তচাপ। এই চাপ নির্ভর করে হৃৎপিন্ডের কর্মক্ষমতা এবং রক্তনালীর প্রতিরোধের ওপর।

রক্তচাপ মাপার পূর্বে করণীয়

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চা-কফি না খাওয়া, ধূমপান না করা, হেঁটে বা দৌড়ে না আসা, মাপার সময় কথা না বলা, ২ মিনিট ব্যবধানে দুই হাতে দুই বার রক্তচাপ মাপা। এ-ছাড়া ভরপেট খাওয়ার পর না মাপা।

যদি কখনো কারো প্রথম চেক-আপে রক্তচাপ বেশি পাওয়া যায়, তবে তা আসলেই উচ্চ রক্তচাপ কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কমপক্ষে বিভিন্ন সময়ে তিন বার (সম্ভব হলে ছয় বার) রক্তচাপ মেপে দেখতে হবে। যদি রক্তচাপ প্রতিবারই বেশি থাকে, তবে তা নিশ্চিতই উচ্চ রক্তচাপ।

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ

অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ রোগী অনুভব করে না। চেক-আপ বা অন্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। তবে যে-সব উপসর্গ হতে পারে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা, কাঁধব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, ক্লান্তি বোধ, অবসন্নতা, অতিরিক্ত ঘাম, অনিদ্রা, দমের সমস্যা, চোখ-মুখ অতিরিক্ত জ্বালাপোড়া করা।

উচ্চ রক্তচাপের ধরন

উচ্চ রক্তচাপ মূলত দুই প্রকার

> প্রাইমারি হাইপারটেনশন (৯৫%) এটি সরাসরি জীবনাচারের সাথে সম্পর্কযুক্ত
> সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (৫%) অন্য কোনো রোগের কারণে এটি হয়ে থাকে

প্রাইমারি হাইপারটেনশনের কারণ

> স্থূলতা
>টাইপ-২ ডায়াবেটিস
>অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ খাবার গ্রহণ
>তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার গ্রহণ
>রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ (চিনি, সাদা চাল, সাদা ময়দা)
>রান্নায় অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার এবং লবণযুক্ত অন্যান্য খাবার গ্রহণ
>খাবারে পটাশিয়ামের ঘাটতি
>ভিটামিনের ঘাটতি
>ফাইটোকেমিক্যালের ঘাটতি
>ধূমপান
>অতিরিক্ত মদ্যপান
>ক্রমাগত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস
>নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সেবন

উচ্চ রক্তচাপের ক্ষতিকর প্রভাব

হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা তিন গুণ বেড়ে যায়। হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ে চার গুণ। স্ট্রোকের ঝুঁকি সাত গুণ বেড়ে যায়। আলঝেইমার্স ডিজিজ ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ধমনীর ভেতর-দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সেখানে চর্বি জমতে সাহায্য করে (অ্যাথেরোস্কে-রোসিস)। উচ্চ রক্তচাপ ক্রনিক কিডনি ডিজিজেরও কারণ।

প্রাইমারি হাইপারটেনশনের প্রচলিত চিকিৎসা এবং সীমাবদ্ধতা

প্রাইমারি হাইপারটেনশন একটি লাইফস্টাইল ডিজিজ হলেও বিশ্বব্যাপী যে চিকিৎসা দেয়া হয় তা মূলত ড্রাগ থেরাপি। প্রতিটি ওষুধের রয়েছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কারো ক্ষেত্রে হয় কম, আবার কারো ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত প্রকট। শুধু ওষুধ দিয়ে যারা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করান, তাদের ক্ষেত্রে প্রথমদিকে একটি ওষুধে কাজ হলেও কিছুদিন পর দু-তিনটি ওষুধ নেয়ার পরও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হতে চায় না।

শুধু ওষুধ সেবন করে যে রোগী উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করে  থাকেন, তিনি তো কোনোদিনই উচ্চ রক্তচাপের হাত থেকে রেহাই পান না, উপরন্তু ধীরে ধীরে একটা সময় তিনি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদিতে আক্রান্ত হন।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট ন্যাশনাল কমিটি অন দ্য প্রিভেনশন, ডিটেকশন, ইভ্যালুয়েশন এন্ড ট্রিটমেন্ট অব হাই ব্লাড প্রেশার (জেএনসিভিআই)-এর সর্বশেষ পরামর্শ  হচ্ছে : স্টেজ-১ এবং স্টেজ-২ উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ওষুধ শুরু করার আগে কমপক্ষে ৩-৬ মাস ওষুধ না দিয়ে শুধু জীবন-অভ্যাস পরিবর্তন করে চিকিৎসা করা উচিত। 

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাস

চারপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমরা ধরেই নিয়েছি যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে একপর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়বে। এরপর ডাক্তারের কাছে যাব। ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ খেতে দেবেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ওষুধ খাওয়াই হচ্ছে নিয়তি। অথচ এটিই একমাত্র বাস্তবতা নয়।

গবেষকেরা ১৯২০ সালে কেনিয়ার গ্রামের কিছু মানুষের জীবনধারা নিয়ে গবেষণা করলেন। তাদের খাদ্যতালিকায় সোডিয়ামযুক্ত বা লবণাক্ত খাবার খুব কম থাকে। আর থাকে পূর্ণ শস্যদানা, পর্যাপ্ত শাকসবজি, ফল, ডাল-বীজ-বিন এবং খুব অল্প প্রাণিজ আমিষ। দেখা গেছে, ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামীণ কেনিয়ানদের রক্তচাপ থাকে সমবয়সী আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের মতো ১২০/৮০ মি.মি. মার্কারি।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের রক্তচাপ বাড়তে থাকে, ৬০ বছর বয়সে তাদের রক্তচাপ হয় ১৪০/৯০-এর ওপরে। অথচ ৬০ বছর বয়সে কেনিয়ানদের রক্তচাপ বরং আগের থেকে কমে দাঁড়ায় ১১০/৭০-এ। দুবছর ধরে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ সময়ে ১৮০০ মানুষ নানা কারণে কেনিয়ার গ্রামের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এদের মধ্যে একজনও উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিল না। এমনকি তাদের মধ্যে একজনেরও ধমনীতে চর্বি জমা বা হার্ট ব্লকেজের সমস্যা ছিল না।

উচ্চ রক্তচাপ নিরাময়ে আধুনিক গবেষণা

যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক ডা. জুলিয়ান হুইটেকার ২৫ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন। জীবনধারা পরিবর্তন করার পর একপর্যায়ে তার রোগীরা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ছেড়ে দিয়েছেন এবং ওষুধ ছাড়াই সুস্থ জীবনযাপন করছেন। 

তার এ গবেষণার ফলাফল তিনি তুলে ধরেন রিভার্সিং হাইপারটেনশন গ্রন্থে। এ-ছাড়াও যারা হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস নিয়ে কাজ করছেন, তারাও জীবনধারা পরিবর্তন করে হৃদরোগ-ডায়াবেটিসের পাশাপাশি তাদের রোগীদের উচ্চ রক্তচাপও নিরাময় করতে সক্ষম হন। 

উচ্চ রক্তচাপ নিরাময়ে করণীয়

>স্থূলতা হ্রাস বা ওজন নিয়ন্ত্রণ
>মাছ মাংস ডিম দুধ বর্জন
>তেল ছাড়া খাবার গ্রহণ
>তেল-চর্বি-কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার বর্জন
>চিনি ও অন্যান্য রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট বর্জন
>খুব কম লবণে রান্নার অভ্যাস করা এবং লবণযুক্ত খাবার বর্জন
>পর্যাপ্ত পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ
>পর্যাপ্ত এন্টি-অক্সিডেন্ট ভিটামিন ও নাইট্রিক অক্সাইড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ
>ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ও কো-এনজাইম কিউ ১০ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ
>পর্যাপ্ত ফাইটোকেমিক্যাল সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া। 

এমএম/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি