ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ডায়াবেটিস: ওষুধ ছাড়াই নিরাময়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:০৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ডায়াবেটিস হচ্ছে বর্তমান সময়ের অন্যতম লাইফস্টাইল ডিজিজ। আমেরিকায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ৯ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ৩ জনে একজন প্রি-ডায়াবেটিক। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের প্রতি ৩ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে।

বাংলাদেশেও এ রোগের প্রকোপ হু হু করে বাড়ছে। এদেশে প্রতি ১০ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সপ্তম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। বিশ্বজুড়েই বিস্তৃত হয়েছে এর করাল থাবা। তাই ডায়াবেটিসকে এখন বলা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর প্লেগ।

ডায়াবেটিস কী?

প্রতিটি বাহনের জন্যে প্রয়োজন জ্বালানি, যেমন : ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ইত্যাদি। শরীররূপী আমাদের এই বাহনেরও জ্বালানি প্রয়োজন। শরীরের মূল জ্বালানি হচ্ছে গ্লুকোজ। আমাদের শরীরের যত ধরনের কাজ আছে- নড়াচড়া হাঁটা দৌড়ানো চিন্তা করাসহ সকল ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয় গ্লুকোজ। শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের পর হজমশেষে গ্লুকোজ ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করে। ইনসুলিনের সাহায্যে গ্লুকোজ রক্ত থেকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং বিপাকক্রিয়ায় অংশ নিয়ে শক্তি তৈরি করে।

কোনো কারণে রক্ত থেকে গ্লুকোজ কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে রক্তে গ্লুকোজ জমা হতে থাকে। ফলে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে যায়। একপর্যায়ে এই বাড়তি গ্লুকোজ কিডনি প্রস্রাবের সাথে বের করে দেয়।

রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ কিন্তু কোষের মধ্যে গ্লুকোজ স্বল্পতা, আর প্রস্রাবে গ্লুকোজের উপস্থিতি- এই অবস্থার নামই ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ

বার বার ক্ষুধা লাগা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অবসন্নতা, ওজন কমে যাওয়া, অপুষ্টি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ঘটনাচক্রে অর্থাৎ অন্য কোনো রোগের চিকিৎসায় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকালে।

ডায়াবেটিস নির্ণয় করার উপায় 

জেনে অবাক হবেন, আমাদের রক্তে যে পরিমাণ সুগার বা চিনি থাকে তার পরিমাণ মাত্র এক চা চামচ। আমরা যদি প্রতিদিন চা, কফি, কোমল পানীয়, মিষ্টান্ন, অন্য কোনো খাবারের সাথে ২-৩-৪-৫ চা চামচ চিনি খাই, তখন রক্তের সুগার বেড়ে দাঁড়ায় কয়েকগুণ। যা স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ।

ডায়াবেটিসের ধরন

১. টাইপ-১ ডায়াবেটিস: এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় থেকে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না। একমাত্র চিকিৎসা ইনসুলিন। এটি জীবনাচারের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।

২. টাইপ-২ ডায়াবেটিস: এ-ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন তৈরি হলেও শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধিতা সৃষ্টির ফলে শরীর যথাযথভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। ভুল জীবনাচারের কারণে এটি হয়ে থাকে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস কীভাবে হয় তা বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে কীভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এ ব্যাপারে দুটি তত্ত্ব আছে।

তত্ত্ব-১

আমরা যখন প্রাণিজ আমিষ এবং তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত খাবার খাই, তখন এই চর্বি শরীরে গিয়ে কোষে প্রবেশ করে। কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া তখন এই চর্বিকে পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করে। কিন্তু অতিরিক্ত তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে কোষের ভেতর অধিক পরিমাণে এই চর্বি প্রবেশ করে, যা মাইটোকন্ড্রিয়া পুরোপুরি বার্ন-আউট করতে পারে না। ফলে তা কোষের মধ্যে জমতে থাকে। একপর্যায়ে এই সঞ্চিত চর্বি কোষের স্বাভাবিক কাজে বাধার সৃষ্টি করে।

যদি কেউ আপনার দরজার লক-এ চুইংগাম ঢুকিয়ে দেয়, তখন আপনি যেমন দরজার লক খুলতে পারবেন না তেমনি কোষের ভেতর অতিরিক্ত চর্বি জমার ফলে ইনসুলিন তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। কেননা ইনসুলিন রিসেপ্টরের গায়ে চর্বির প্রলেপ জমে গেছে। অর্থাৎ ইনসুলিন কোষের ভেতরে গ্লুকোজ প্রবেশে সাহায্য করতে পারে না, যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধিতা নামে পরিচিত। 

তত্ত্ব-২

রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা) এবং চিনিসমৃদ্ধ খাবার (চা কফি জুস পিঠা পায়েস মিষ্টান্ন ও কোমল পানীয় ইত্যাদি) খেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে প্রবেশ করে। লিভার এই অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত করে লিভারেই জমা করে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্যে।

আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমাইনো এসিড (আমিষের ক্ষুদ্রতম অংশ) রক্তে প্রবেশ করলে তা লিভার কর্তৃক প্রথমে গ্লুকোজ এবং পরে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয়ে লিভারেই জমা হয়। যখন লিভারে আর গ্লাইকোজেন জমা হওয়ার জায়গা থাকে না, তখন লিভার অতিরিক্ত গ্লুকোজকে চর্বি বা ফ্যাটে (ট্রাইগ্লিসারাইড) রূপান্তরিত করে।

এই রূপান্তরিত ফ্যাট লিভার থেকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জমা হতে থাকে, বিশেষ করে মাংসপেশিতে এবং পেটের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন অঙ্গে ও এর চারপাশে। একটা পর্যায়ে এই অতিরিক্ত চর্বি লিভারেও জমা হতে থাকে। ফলাফল ফ্যাটি লিভার, যা প্রকারান্তরে তৈরি করে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হওয়ার পেছনে তত্ত্ব-১ এবং তত্ত্ব-২ দুটোর ভূমিকাই থাকে। 

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ

> স্থূলতা
> ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স
> অতিরিক্ত তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত-কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার
> রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা)  
> চিনিসমৃদ্ধ খাবার (চা কফি জুস পিঠা পায়েস মিষ্টান্ন ও কোমল পানীয়)
> প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ  
> শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন কমে যাওয়া
> শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
> ক্রমাগত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস

ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব

দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগলে যে-সব রোগ হতে পারে তার মধ্যে করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ (৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত), স্ট্রোক, অন্ধত্ব, কিডনি রোগ, গ্যাংগ্রিন, ক্যান্সার অন্যতম।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রচলিত চিকিৎসা

বিশ্বব্যাপী যত ডায়াবেটিস রোগী আছে তার ৯০ শতাংশই আক্রান্ত টাইপ-২ ডায়াবেটিসে। প্রচলিত চিকিৎসায় বলা হয়, এ রোগ ভালো হয় না। যেহেতু ডায়াবেটিস রোগে রক্তের সুগার লেভেল সহজেই বেড়ে যায়, তাই এর চিকিৎসায় চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কম-পরিমিত খেতে বলা হয় যেন রক্তের সুগার লেভেল বেড়ে যেতে না পারে। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করার পরও ডায়াবেটিস উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। রক্তের এই বাড়তি সুগার কমানোর জন্যে তখন ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

এত কিছুর পরও সুগার নিয়ন্ত্রণ না হলে একপর্যায়ে ইনসুলিন দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, প্রচলিত নিয়ম মানার পরও রক্তের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ হয় না। ফলে ইনসুলিনের ডোজ বাড়তে থাকে। আবার ইনসুলিন নেয়ার পর শর্করা জাতীয় খাদ্যের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। কেননা একটু এদিক-ওদিক হলে রক্তের সুগার লেভেল অতিরিক্ত কমে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) সৃষ্টি হতে পারে।  

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি

জীবনদৃষ্টি ও জীবনাচার পরিবর্তন করে যে ডায়াবেটিস নিরাময় করা যায়- এই বিষয়ে প্রথম গবেষণা করেন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ডা. নিল বার্নার্ড। এ গবেষণায় আরো এগিয়ে আসেন ডা. জোয়েল ফুরম্যানসহ অন্যান্য গবেষকরা। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারে আমূল পরিবর্তন এনে তারা ডায়াবেটিস নিরাময় করতে সক্ষম হন।

তাদের প্রোগ্রাম অনুসারে ডায়াবেটিস নিরাময়ে করণীয়

বর্জন করুন (কমপক্ষে একবছর)

> মাছ মাংস ডিম দুধ
> তেল ঘি মাখন ডালডা মার্জারিন
> তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত ভাজাপোড়া খাবার
> চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা
> প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার

প্রতিদিন খান

> পূর্ণ শস্যদানা: লাল চালের ভাত বা লাল আটার রুটি এবং এর পরিমাণ হবে খুবই কম। চাইলে ভাত বা রুটির পরিবর্তে খুব অল্প পরিমাণে লাল ওটস খেতে পারেন।

> শাকসবজি, সালাদ ও সবুজ পাতা : হতে হবে পর্যাপ্ত।

> ডাল মটরশুঁটি বিন বীজ : পরিমিত ও নিয়মিত।

ফল: প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ ধরনের টক ও কম মিষ্টি ফল খান এবং ওষুধবন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বেশি মিষ্টি ফল, যেমন: খেজুর, আম, কাঁঠাল, তরমুজ, লাল আপেল ইত্যাদি বন্ধ রাখুন।

এ-ছাড়াও ডায়াবেটিসের রোগীরা খেতে পারেন

> খুব অল্প পরিমাণ আখরোট কাঠবাদাম এবং তিসি চিয়া তিল সূর্যমুখী ও মিষ্টিকুমড়ার বীজ, সয়াদুধ।

প্রতিদিন সকালে ১ গ্লাস করে কাঁচা করলার জুস, মেথি ভিজানো পানি ও ঢেঁড়স ভিজানো পানি এবং রাতে ৩ চা চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনেগার।

> প্রতিদিন কিছু দারুচিনি, ১ কাপ হার্বাল চা ও ৩-৪ কাপ গ্রিন টি।

এ-ছাড়াও ডায়াবেটিসের রোগীরা যা যা করবেন

> প্রতিদিন একঘণ্টা ব্যায়াম। ব্যায়াম ইনসুলিনের প্রতি শরীরের কোষগুলোর সংবেদনশীলতা বাড়ায়, ফলে ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে কোষের ভেতরে প্রবেশ করাতে সমর্থ হয়। এ-ছাড়াও ব্যায়ামের ফলে সৃষ্ট পেশিসংকোচন গ্লুকোজ পরিবহন বাড়ায়, যা ইনসুলিনের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। অর্থাৎ ইনসুলিনের সহযোগিতা ছাড়াই গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করে। তাই ব্যায়াম করলে ব্লাড সুগার লেভেল বেশ কিছুটা কমে। ফলে ডায়াবেটিস দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

> প্রতিদিন দুই বেলা মেডিটেশন
> প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ দফা প্রাণায়াম
> প্রতিদিন কিছু সময় সূর্যস্নান
> সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন রোজা/ উপবাস/ ফাস্টিং

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া। 

এমএম/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি