তামাকমুক্ত বাংলাদেশ: বিজ্ঞান কি উপযুক্ত সমাধান দিতে পারবে?
প্রকাশিত : ১৭:৪২, ৩০ আগস্ট ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৪৯, ৩১ আগস্ট ২০২৩
বাংলাদেশে নন-কমিউনিকেবল ডিজিসেস (এনসিডি) অর্থাৎ অসংক্রামক রোগের মাত্রা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। যার ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক রেসপিরেটরি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী নানা রোগ ও এতে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে চলছে।
এছাড়াও, অধিকাংশ মানুষ হাইপার টেনশন ও ডায়াবেটিসের প্রভাবে আক্রান্ত যার মধ্যে ক্যান্সার রোগীদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেশি। একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে, এসব রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশ নানাভাবে বিভিন্ন ধরনের তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত।
ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেস-এর (ডিজিএইচএস) এনসিডি কন্ট্রোল ইউনিট দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারই এনসিডি ঝুঁকির জন্যে প্রধানত দায়ী। সমীক্ষায় আরও দেখা যায় যে, মোট জনসংখ্যার ৪৪.৯ শতাংশ ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন উভয় প্রকার তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ করে। এই সংখ্যক ধূমপায়ীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে তাদের পরিস্থিতির উন্নতি ও স্বাস্থ্যসুরক্ষায় নিত্যনতুন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ এবং বৈজ্ঞানিকভাবে ক্ষতি কমানোর বিকল্প পদ্ধতি অন্বেষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়ে নিকোটিন এবং এর সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে একটি বিতর্কের সূচনা হয়েছে। ভুল তথ্য এবং সচেতনতার অভাবে নিকোটিনের প্রভাব এবং দহনের সাথে এর প্রকৃত সম্পর্কটি সকলের বোধগম্য হতে ব্যর্থ হয়েছে, যা মানব স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে। আমাদের জানা উচিত নিকোটিন শুধু একটি আসক্তি মাত্র এবং এটি কোন রোগের কারণ নয়। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস-এর এক গবেষণা মতে, ধূমপানের সময় দহন প্রক্রিয়ার সরাসরি ফলাফল হলো কার্বন মনোক্সাইড, টার এবং কার্সিনোজেন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ যা মানবস্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। নিকোটিন ও ধূমপানের দহন প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি কিংবা ক্ষতিহ্রাসকারী বিকল্পগুলো সহজলভ্য করার মাধ্যমে নিকোটিন সেবনকারীদের ক্ষতিকারক টক্সিন গ্রহণের মাত্রা কমানো সম্ভব।
কয়েক দশকের গবেষণার ফলাফলস্বরুপ কিছু বিকল্প তৈরি হয়েছে যেগুলো তামাক পোড়ানোর পরিবর্তে একে গরম করে থাকে। এই পদ্ধতিটি তামাক আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে ধূমপান ছাড়তে একটি নিরাপদ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু এখানে তামাক পোড়ানো হয় না, তাই নির্গত ক্ষতিকারক রাসায়নিকের মাত্রাও সিগারেটের ধোঁয়ার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কমঝুঁকিপূর্ণ এই বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে জাপানে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই ধূমপানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
তবে, ধূমপানের এই বিকল্পগুলো নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক এবং তামাক শিল্পের মধ্যে নানবিধ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন যে এইচটিপি-এর প্রচার অসাবধানতাবশত ধূমপানকে উৎসাহিত করতে পারে কিংবা বর্তমান ধূমপায়ীদের এই আসক্তি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া থেকে বিমুখ করতে পারে। ক্ষতি কমানোর জন্য ব্যবহৃত এই বিকল্পগুলোর বাজারজাত নীতি প্রণয়নের সময় এর বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণগুলো সাবধানতার সাথে সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বিবেচনা করা উচিত।
বর্তমান ধূমপায়ীদের জন্য নিরাপদ বিকল্পের সুবিধা নিশ্চিত করা এবং অধূমপায়ীদের সিগারেট ও নিকোটিন সেবন করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে বাজারজাতকরণে এই দুইপক্ষের ভারসাম্য বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এটি স্পষ্ট যে, ধূমপান নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরোনো "ছাড়ুন অথবা মরুন" স্লোগানটি উপযুক্ত নয়, কারণ ইতোমধ্যেই লক্ষ লক্ষ জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করতে পারি যেখানে ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলোকে পেছনে ফেলে সবাই নিজেরাই নিজেদের সুস্থতায় অবদান রাখতে পারে। ভোক্তাদের মাঝে বিশ্বাসযোগ্য, প্রমাণ-ভিত্তিক তথ্য, এবং বিজ্ঞান-ভিত্তিক পণ্যগুলো ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে এই সমাজকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করার সুযোগ রয়েছে।
লেখক:
ডক্টর অব মেডিসিন (অনকোলজি)
এটেন্ডিং কনসাল্টেন্ট
এভারকেয়ার হসপিটাল, চট্টগ্রাম।