ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

দালালদের হাতে জিম্মি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৪৮, ২১ জুলাই ২০১৮

সরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেশের সবচেয়ে বড় নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হলেও দালাল ও বহিরাগতদের দাপটে সাধারণ রোগীরা এখানে অসহায় বলেই জানা গেছে। দিনের পর দিন এমন অনিয়ম চললেও মুখ বন্ধ করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া মানুষের অধিকার হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রতি পদে পদেই খরচ করতে হয় টাকা। এই টাকা অায়কে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে একটি অবৈধ বহিরাগত সিন্ডিকেট। যারা হাসপাতালের বেতনভুক্ত কর্মচারী না হয়েও নিয়ন্ত্রন করে রোগীদের চিকিৎসা। সরকারি আওতাভুক্ত না হয়েও অবাধে কাজ করে তারা। রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের হয়রানি করে টাকা অাদায় করাই তাদের অায়ের অন্যতম উৎস। কেউ প্রতিবাদ করে না। করলেও কোন লাভ হয় না। বরং যিনি প্রতিবাদ করবেন তাকেই পরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।

বাগেরহাটের হানিফ ( ছদ্মনাম) চিকিৎসা নিতে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। জরুরি বিভাগে নিবন্ধিত হওয়ার পর তাকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাওয়া হবে অর্থোপেডিক বিভাগে। হুইল চেয়ার নিয়ে দৌড়ে এলেন দু`জন কর্মচারী। তাকে টানা হেঁচড়া করে পৌঁছানো হয় অর্থোপেডিক বিভাগে। এর পর পরই দাবি করা হয় টাকা। দু`জনকে দু`শ টাকা দিতে হবে। রোগীর অভিভাবক একশ টাকা দিলে দু`জন কর্মচারী উত্তেজিত হয়ে উঠেন। শুরু হয় বাক বিতণ্ডা।
কর্মচারী দু`জনের দাবি দু`জনকে দু`শ টাকা দিতে হবে। কিন্তু রোগীর অভিভাবকরা একশ টাকার বেশি দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত দেড়শ টাকা দিয়ে পাওয়া যায় রেহাই।

প্রশ্ন হচ্ছে এই দু`জনকে? না, তারা হাসপাতালে চাকরি করেন এমন কেউ নন। হাসপাতালের সঙ্গে তাদের কোন ধরণের সম্পর্ক নেই। তারপরও তারাই সব। এই দু`জনের মতো অসংখ্য কর্মচারী ও দালালদের হাতেই জিম্মি ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

এক্ষেত্রে এসব অপরাধীদের যুক্তি, আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা পাই না। আপনার রোগীর কাজ করছি, টাকা দেন। অন্যদিকে রোগীর অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে যদি এভাবে পদে পদে টাকা খরচ করতে হয় তাহলে সরকারি হাসপাতালে অাসার দরকার কী?

শুধু রোগীকে হুইল চেয়ারে করে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং তারপর থেকে প্রতিটি ধাপেই টাকা দিতে হয়। তবে এসব অায়া- বুয়া বা নার্স- ব্রাদাররা এটাকে ঘুষ বলতে অাপত্তি করেন। তাদের ভাষায় এটা বকসিশ। নির্দিষ্ট পরিমাণ সিটের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সিট বরাদ্দ পেতে দিতে হয় টাকা। রোগীর স্যালাইন লাগানো, ড্রেসিং করানো, বিছানার চাদর- বালিশ পাল্টে দেওয়া, পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীর থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহসহ সব কিছুতেই টাকা দিতে হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রোগী যতই গুরুতর হোক না কেন, টিকেট না কাটলে তাকে কোনো ডাক্তার দেখতে আসেন না। এখানেও পোহাতে হয় ভোগান্তি। অনেক সময় ১০ টাকার টিকেট ১৫-২০ টাকায়ও বিক্রি করতে দেখা গেছে। যদিও বা হাসপাতালের চারদিকে লেখা রয়েছে দালাল হতে সাবধান, কিন্তু নিয়মকানুন যেন ঠিক এর উল্টো- দালাল ছাড়া কোনো কাজ কল্পনাও করা যায় না।

মেডিসিন বিভাগের বারান্দায় গত কয়েকদিন ধরে অাছেন নাজমা অাক্তার ( ছদ্মনাম)। তার অভিযোগ তিনি অাসার পর বেশ কয়েকটি সিট খালি হলেও তিনি টাকা দিতে না পারায় তাকে নিচে থাকতে হচ্ছে। অথচ তার পরে অাসা অনেক রোগী টাকা দিয়ে বরাদ্দ পাচ্ছেন সিটের। অাশে পাশের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝা যায়, এটা এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার।

সূত্র অনুযায়ী, হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা নিলেও এরা নিজেরা কাজ না করে বহিরাগতদের কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। রোগীরাও বাধ্য হচ্ছেন, বহিরাগতদের সেবা নিতে। এই সুযোগে রোগীদের জিম্মি করে চাহিদামতো অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আর এ টাকা থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার এবং নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও কমিশন পাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা- কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ধরনের অভিযোগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধিকাংশ কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে শেখ ফরিদ আলম, আবদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, মিনা আক্তার, শুক্কুর মিয়া, সালাহ উদ্দিন, টিটু, শফিকুল ইসলাম, বাসেদ, মতিজিয়া আক্তার এসব নামগুলো বেশ অালোচিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার দাবি, এসব সরকারি কর্মচারী কোনো সেবা দেওয়া ছাড়াই মাস শেষে নিয়মিত বেতন তুলছেন। এরা প্রতি সপ্তাহে একদিন হাজিরা দেন। আর এজন্য একজন ওয়ার্ড মাস্টার ও জমাদারকে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।

দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগটি নিয়ন্ত্রন করে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন বহিরাগত। এদের মধ্যে আলম, আজিজ, দেলোয়ার, স্বপন, আইয়ুব এবং পুরু মিয়ার নেতৃত্বে তিন শিফটে হাসপাতালের ট্রলি দখল করে অর্থের বিনিময়ে রোগীদের ওয়ার্ডে নেওয়ার কাজ করছেন। এদের মধ্যে আওয়াল, সুজন, লিটন, সাইফুল, মতিয়ার, হানিফ, আকাশ, মুকুল, নজরুল ইসলাম, ইদ্রিস, ফরিদ, সেলিম, হাসেম, ফয়েজ, স্বপন, ফয়সাল, লতিফ, রবিন, শহিদ, রায়হান, জাহাঙ্গীর অন্যতম। এরা প্রতিদিন প্রতি শিফটে সরদারদেরকে ১০০ টাকা ও ওয়ার্ড মাস্টারকে ২০০ টাকা করে দিয়ে হাসপাতালের ট্রলিগুলো দখল করে রোগী ও তাদের স্বজনদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি শিফটে তাদের অায় ৫০০ টাকার বেশি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে প্রায় ৩০০টি। এই অ্যাম্বুলেন্সকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সক্রিয় দালাল চক্র। তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের প্রভাবিত করে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে কমিশন পাচ্ছেন ক্লিনিকগুলোতে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক খাজা আবদুল গফুর বলেন, হাসপাতালে ট্রলি ঠেলার নিজস্ব লোক রয়েছে। আর রোগীর চাপ পড়লে অনেক সময় বহিরাগতরা রোগীদের সহযোগিতা করে থাকতে পারে। কিন্তু রোগীদের জিম্মি করা বা অন্য যে কোনো বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, এখনো পর্যন্ত কেউ অামাদের এধরণের কোন অভিযোগ করেনি।

পিসিসিইউ বিভাগের ৬নং বেডের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অাবদুল হালিম। তার বড় ছেলে সাইফুল ইসলাম জাবেদ জানান, তার বাবাকে জরুরি বিভাগ থেকে প্রথমে ট্রলিতে করে ৬০২নং ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। তখন ট্রলিম্যান তার কাছ থেকে জোরপূর্বক ২০০ টাকা আদায় করেন। ওই একই দিনে তিনতলায় পিসিসিইউতে তাদের সিটের ব্যবস্থা হলে ৬০২নং ওয়ার্ড থেকে সেখানে যান। যাওয়ার সময় ৬০২নং ওয়ার্ডের দারোয়ান ৫০ টাকা দাবি করেন। পরে তাকে ৩০ টাকা দিতে হয়। আর আয়াকেও ৫০ টাকা দেওয়া হলে সে হুইল চেয়ারে করে সেখানে আনতে রাজি হয়।

১০০নং ওয়ার্ডের ৪৩নং বেডের রোগী বেলাল হোসেন জানান, এখানে সবাই নিরুপায় হয়ে টাকা দিয়ে কাজ করাতে বাধ্য হয়। টাকা না দিলে ট্রলি বা হুইল চেয়ার কিছুই পাওয়া যায় না। তখন বাধ্য হয়ে যার যার রোগীকে কোলে করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই একরকম বাধ্য হয়েই তাদের শরণাপন্ন হতে হয়।

শিগগিরই এসবের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও ঢামেক কর্তৃপক্ষ সোচ্চার হবেন সেটাই প্রত্যাশা।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি