আলঝেইমার্স: যে রোগে আচরণ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়
প্রকাশিত : ২৩:৫৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯
ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের এমন এক ধরনের সমস্যা যা মানুষের স্মৃতি, চিন্তা, আচরণ ও আবেগকে প্রভাবিত করে। বয়সের সাথে সাথে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ও হার বাড়তে থাকে। বিশ্বের নানা দেশের গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬৫ বছরের অধিক বয়সী জনগোষ্ঠীর মাঝে মাঝারি থেকে শুরুতর স্মৃতিভ্রংশের হার ৫ শতাংশ, আর ৮৫ ঊর্ধ্ব মানুষের মাঝে এ হার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ আলঝেইমার্স সোসাইটির এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে নয় লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
যেসব রোগের কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আলঝেইমার্স রোগ। ১৯৭০ সালে জার্মান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যালয়েস আলঝেইমার এ রোগটির বর্ণনা করেন। পরবর্তীতে তার নামানুসারে এ রোগের নামকরণ করা হয়।
আলঝেইমার্স রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর স্মৃতিশক্তি, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি লোপ পেতে থাকে। রোগী সকালে কী খেয়েছেন তা দুপুরেই ভুলে যেতে পারেন। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাও মনে করতে পারেন না। পরবর্তীতে সময় ও স্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দেয়, পরিচিত লোকজনকেও চিনতে অসুবিধা হয়।
চিন্তাশক্তি, বোধ বা ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে, ফলে রোগীর জীবনযাপন এমনটি দৈনন্দিন কাজকর্ম করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রোগাক্রান্তদের নিজেদের জীবনযাপন এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্ম করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রোগাক্রান্তরা নিজেদের শারীরিক যত্ন নিতেও অক্ষম হয়ে পড়েন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
অনেকের আচরণ, আবেগ, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে পারে। কেউ আবার বিষন্নতা ও সন্দেহবাতিকতার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ইমেজিং পরীক্ষায় দেখা গেছে, রোগাক্রান্তদের মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যায়, এর ভেন্ট্রিকল বা প্রকোষ্ঠ বড়ো হয়, কর্টেস্ক ও হিপ্পোক্যাম্পাস অংশের স্নায়ুকোষের ক্ষয় হতে থাকে। স্মৃতি-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমানগত তারতম্য বিশেষত অ্যাসিটাইলকোলিনের কর্মক্ষমতায় ঘাটতি দেখা দেয়।
দ্রুত রোগ শনাক্ত করা অ্যালঝেইমার্স রোগ চিকিৎসার জন্য জরুরী। এ রোগের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রোগের অবনতির গতি ধীর করা এবং রোগীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কার্যকর কোন চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে রোগীর উপসর্গ ও লক্ষণভেদে কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো উপশমের বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কিছু ঔষুধ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে কিছু ঔষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে যা স্মৃতিশক্তি কিছুটা ধরে রাখতে সহায়তা করে।
এ ছাড়া রোগীদের আনুষঙ্গিক অন্যান্য মানসিক উপসর্গ যেমন, অনিদ্রা, হতাশা প্রভৃতির জন্য চিকিৎসকরা কিছু ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে এদের আনুষঙ্গিক আরও শারীরিক রোগ থাকে, যেগুলো চিকিৎসা অ্যালঝেইমার্স রোগের কারণে ব্যাহত হতে পারে। সে কারনে এ সব রোগীর বিশেষ যত্ন ও সতর্কতা প্রয়োজন। রোগীর চারপাশের পরিবেশ তার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
রোগীকে এক কোথাও যেতে দেওয়া উচিত হবে না। কারণ, রোগাক্রান্তের ভুলে যাওয়ার সমস্যার কারণে এরা পথ ভুলে হারিয়ে যেতে পারেন। রোগীর পকেটে সব সময় নাম, ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বর সম্বলিত একটি কার্ড বা কাগজ রাখা ভালো, কোন কারণে রোগী হারিয়ে গেলে তা কাজে লাগবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ।
এমএস/এসি