ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী কিম ইয়ো জং

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০০:২১, ২১ জুন ২০২০

ভাই কিম জং আনের সঙ্গে ছোট বোন কিম ইয়ো জং- সংগৃহীত

ভাই কিম জং আনের সঙ্গে ছোট বোন কিম ইয়ো জং- সংগৃহীত

গত কয়েক বছরে উত্তর কোরিয়ার দুর্বোধ্য ক্ষমতা কাঠামোতে কিম ইয়ো-জং একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কিম ইয়ো-জং হচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-আনের ছোট বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে তাকেই কিম জং-আনের একমাত্র মিত্র বলে মনে করা হয়। খবর বিবিসি’র।

কিম ইয়ো-জং প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি আকর্ষণ করেন ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে। সে বছর তিনি উত্তর কোরিয়ার শীতকালীন অলিম্পিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া সেবার শীতকালীন অলিম্পক গেমসে একটি একক দল হিসেবে অংশ নিচ্ছিল। কিম ইয়ো-জং হচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন কিম পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন।

২০১৮ সালে উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করে। এরপর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাকে তার ভাইয়ের পাশে থেকে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। সে বছর কিম জং-আন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ বৈঠকের সময় তখন ভাইয়ের পাশে দেখা গিয়েছিল কিম ইয়ো-জং কে।

ভাইয়ের সঙ্গে তার এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে তার এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাকে ২০২০ সালের এপ্রিলে আবারও আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। তখন কিম জং-আনকে হঠাৎ করেই কিছুদিন জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছিল না। এটা ছিল খুবই অস্বাভাবিক। তার স্বাস্থ্য নিয়ে তখন নানা গুজব শোনা যাচ্ছিল। উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে তখন কিম ইয়ো -জং এর কথা বেশ আলোচিত হচ্ছিল।

ইয়ো জং প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদোন্নতি পেয়ে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হন ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। এর আগে তিনি ছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রপাগান্ডা এন্ড এজিটেশন ডিপার্টমেন্ট, অর্থাৎ প্রচারণা এবং আন্দোলন দপ্তরের ভাইস ডিরেক্টর। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। কিম ইয়ো-জং এখনও এই দায়িত্বে আছেন এবং সেখানে তার কাজ মূলত উত্তর কোরিয়ায় তার ভাইয়ের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা।

উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সেই তালিকায় কিম ইয়ো-জং এর নামও আছে। এর মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কোন নাগরিক তার সঙ্গে কোনো ধরনের কাজকর্ম করতে পারবে না, এটা নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে তার সম্পদ এবং বাড়িঘর জব্দ করা হবে।

কিম ইয়ো-জং কতটা ক্ষমতাবান:
উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা কাঠামো ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝা খুবই কঠিন। কাজেই সেখানে কিম ইয়ো-জং নিজে কি ধরনের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছেন সেটা অনুমান করা আরও কঠিন। উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পার্টির সাধারণ সম্পাদক চু রায়ং’র ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বলে গুজব আছে। যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে উত্তর কোরিয়ায় তার একটা আলাদা শক্তিশালী অবস্থান আছে।

অলিভার হোথাম হচ্ছেন এনকে নিউজের একজন সম্পাদক। তিনি বিবিসিকে বলেন, কিম ইয়ো-জং এর বয়স এখনো তিরিশের কোঠায়। উত্তর কোরিয়ায় সাধারণত এ রকম বয়সের এক জনের খুব বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি থাকে না। ধরে নিতে হবে তার যে প্রভাব-প্রতিপত্তির বেশিরভাগটাই তার ভাইয়ের সূত্রে। সম্প্রতিক সময়ে কিম ইয়ো-জং’র উপরেই দায়িত্ব পড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে খুবই কঠোর ভাষায় একটি বার্তা দেয়ার জন্য। দুই কোরিয়ার মধ্যকার সমস্ত বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো তাকেই দেয়া হয়েছে।

জুন মাসে কিম ইয়ো-জং হুমকি দেন যে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের অসামরিক অঞ্চলে সৈন্য পাঠাবেন। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উস্কানিমূলক লিফলেট পাঠানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে তিনি এই হুমকি দেন। তখন তিনি আরো হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, সীমান্ত শহর কেসং’র কাছে দুই কোরিয়ার যে লিয়াজো অফিসটি আছে, সেটি ধসে যাবে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে এই অফিস থেকে উত্তর কোরিয়া নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।

এর কয়েকদিন পরেই গত ১৬ জুন সেখানে একটি বিরাট বিস্ফোরণ শোনা যায় এবং আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী থেকে সরকারের লোকজন নিশ্চিত করেন যে এই অফিসটি আসলে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি নির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৮০ লক্ষ ডলার খরচ দিয়েছিল।

উত্তর কোরিয়ায় কিম বংশধারা কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ:
কিম জং-আনের কোন উত্তরসূরি যদি খুঁজে বের করতে হয়, তাহলে এই পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকতেই হবে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর কোরিয়ার প্রপাগান্ডা চালিয়ে কিম পরিবার সম্পর্কে নানা ধরণের ‘মিথ’ তৈরি করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ‘পেকটু ব্লাডলাইন‌’ বা পেকটু রক্তধারা।

‘পেকটু পর্বতমালাকে’ ঘিরে উত্তর কোরিয়ার অনেক পৌরাণিক গল্পগাঁথা চালু আছে। বলা হয়ে থাকে দেশটির প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সাং এই পর্বতমালা থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। কিম জং-ইলের জন্ম নাকি সেখানে। কিম জং-আন এখনো সেখানে যান যখন তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন এবং সেটির গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরতে চান। এভাবেই কিম পরিবারকে এখন পেকটু রক্তধারা বলে বর্ণনা করা হয়। পেকটু ব্লাডলাইন বা রক্তধারার বাইরের কারও সেখানে ক্ষমতার শীর্ষপদে বসার কোন সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হয়।

ধারণা করা হয় যে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম-আনের সন্তান আছে, কিন্তু তাদের বয়স খুবই কম। কিম ইয়ো-জং যেহেতু এই পরিবারের সদস্য কাজেই তাকে শীর্ষ নেতার পদে বসানো হলে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে সেটা যুক্তি সংগত করা খুব সহজ হবে। কিন্তু যদি ক্ষমতা অন্য কারও হাতে যায়, সেটা কিম ইয়ো-জং এর জন্য বেশ বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। কারণ যিনিই ক্ষমতায় আসুন, তিনি কিম ইয়ো-জংকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাববেন। সওলের কুকমিন ইউনিভার্সিটির ফিওডর টারটিস্কি বলেন, ‘কিম পরিবারেরই অন্য কেউ যদি ক্ষমতায় না আসে, তাহলে কিম ইয়ো-জং এর জন্য ব্যাপারটা একে বারেই সহজ। হয় তাকেই সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নিতে হবে নতুবা তাকে সমস্ত ক্ষমতা এমনকি তার জীবন হারাতে হবে।’

উত্তর কোরিয়ার শাসক পরিবারে তার অবস্থান কোথায়:
কিম ইয়ো-জং উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত নেতা কিম জং ইলের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আন, আরেক ভাই কিম জং-চাওল এবং কিম ইয়ো-জং, এরা তিনজনই একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান। এদের মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোতে কিম জং-চাওলের অবস্থান খুব বেশি উপরের দিকে নয়। কিম ইয়ো-জং এর জন্ম ১৯৮৭ সালে। বয়সে তিনি কিম জং-আনের চেয়ে চার বছরের ছোট। তারা দুজনেই সুইজারল্যান্ডে এক সঙ্গে বড় হয়েছেন, সেখানেই পড়াশোনা করেছেন।

সুইজারল্যান্ডের যে স্কুলে তারা পড়াশোনা করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন কিম ইয়ো-জংকে সেখানে কড়া পাহারায় রাখা হতো। তার দেখাশোনার জন্য সেখানে অনেক লোক ছিল। একবার তার সামান্য ঠান্ডা লেগেছিল। সাথে সাথে তাকে স্কুল থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন রিপোর্টে দাবি করা হয়, তাকে এতটাই কঠোর পাহারার মধ্যে বড় করা হয়েছে যে কিম পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য পর্যন্ত তার সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশার সুযোগ পায়নি।

কিম ইয়ো-জং কী করেন:
২০১৪ সাল হতে কিম ইয়ো-জং এর প্রধান কাজ আসলে তার ভাইয়ের ভাবমূর্তি রক্ষা করা। উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পার্টির প্রোপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তিনি। ২০১৭ সালে তাকে পলিটব্যুরোর একজন বিকল্প সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এ থেকে ক্ষমতা বলয়ে তার প্রভাব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে তিনি প্রোপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের আগের দায়িত্বেও বহাল আছেন। রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তাঁর অন্যান্য দায়িত্বও ভালোভাবে সম্পাদন করেছেন বলে মনে করা হয়। 

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে হ্যানয় শীর্ষ সম্মেলন যখন ব্যর্থ হলো, তখন কিম ইয়ো-জং কে পলিটব্যুরো থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের শুরুতে তাকে আবার সেই পদে পুনর্বহাল করা হয়। ২০১৪ সালের আগে তাকে স্পটলাইটে দেখা যেত খুবই কম। এক বার দেখা যায় ২০১১ সালে, যখন তার বাবার রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়। এরপর বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন ছবিতে তাকে ভাইয়ের পাশে পাশে দেখা যায়।

এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে, ২০০৮ সালে যখন কিম জং-ইলের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, তখন তার উত্তরসূরী কে হবেন সেই পরিকল্পনায় ছোট মেয়ের জন্যও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ঠিক করা হয়। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আন সম্পর্কে যতবারই কোন একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, ততবারই সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে তার বোনের নাম সামনে এসেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলের মতোই ২০১৪ সালেও কিছুদিন কিম জং-আনকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তখনও তার উত্তরসূরি হিসেব কিম ইয়ো-জং এর নাম শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সেবারও কিছুদিন পরেই কিম জং-আনকে আবার প্রকাশ্যে দেখা গেল, যদিও তাকে হাঁটতে দেখা গিয়েছিল লাঠিতে।

এমএস/এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি