ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ফাহিমের বোন যখন ফ্লাটে ঢুকছিলো, ঘাতক তখন লাশ টুকরো করছিলো

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০৮, ১৮ জুলাই ২০২০

ফাহিম সালেহ

ফাহিম সালেহ

Ekushey Television Ltd.

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানে নিজের কেনা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) ফাহিম সালেহর লাশ উদ্ধার করা হয়। ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা ছিল ফাহিমের দেহ। অথচ তিনি মার্ক জাকারবার্গ হতে পারতেন। হতে পারতেন ইলন মাস্ক! বিপরীতে হয়ে গেলেন টুকরো টুকরো লাশ। শরীরের ছিন্নভিন্ন টুকরোগুলোসহ তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে রইলো ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। 

তরুণ বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফলদের একজন। অথচ ফাহিম সালেহ নামের সেই সফল তরুণ নৃশংসভাবে খুন হলেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই! পুলিশের ধারণা, ভাড়াটে প্রফেশনাল কিলারের কাজ এটা। ব্যবসায়ীক বা লেনদেন সংক্রান্ত কোন কারণে খুন হতে পারেন ফাহিম, এমনটাই ধারণা করছে নিউইয়র্কের পুলিশ। খুনের রহস্যভেদ হলেও অবশ্য ফাহিম ফিরে আসবেন না। যে রত্নটি চিরতরে হারিয়ে গেছে, তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না কখনোই।

ফাহিমের মৃত্যুর খবরটা আসার আগে দেশের খুব বেশি মানুষ ফাহিম সালেহ'র নাম জানতেন না। কারণ আড়ালে থেকেই কাজ করতে পছন্দ করতেন এই তরুণ। পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। পরে নিজের অংশের শেয়ার বিক্রি করে ছিলেন পৃষ্ঠপোষক পদে। জোবাইক, যাত্রী-সহ আরও কিছু দারুণ প্রোজেক্টে তিনি ছিলেন বিনিয়োগকারী। এর বাইরে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াতে গোকাডা (Gokada) এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াতে পিকআপ (Picap) নামে আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করেছিলেন ফাহিম। ভালো মুনাফাও অর্জন করেছিলেন সেখান থেকে।

ফাহিমের বাবা-মা দুজনেই বাংলাদেশী। বাবা সালেহ উদ্দিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। আর মা রায়হানা নোয়াখালীর মেয়ে। ফাহিমের জন্ম হয়েছিল অবশ্য সৌদি আরবে। বাবা সালেহ উদ্দিন তখন সেখানে কর্মরত ছিলেন। ফাহিমের জন্মের পরে তাদের পরিবার পাড়ি জমায় আমেরিকায়। যে কারণে ফাহিমের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের সবটাই কেটেছে আমেরিকাতেই। তিনি পড়াশোনা করেছেন ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে, আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ফাহিম ছিলেন দারুণ মেধাবী। মাথায় সারাক্ষণ নতুন নতুন আইডিয়া গিজগিজ করত তার। স্কুল জীবন থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার সীমাহীন আগ্রহ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি টিনেজারদের জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট বানিয়েছিলেন, নাম টিন-হ্যাংআউট ডটকম। শুরুর দুই বছরের মাথায় বছরে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় হয় এই সাইট থেকে। আঠারো বছর বয়সেই কোটিপতি বনে গিয়েছিলেন ফাহিম! এরও আগে উইজ টিন নামের একটা ওয়েবসাইট তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন স্কুলে। বেশ ভালো অংকের টাকা আয় হয়েছিল তখনও।

তিনি খানিকটা শঙ্কায় ছিলেন। টাকা দিয়ে মানুষ এরকম সার্ভিস ব্যবহার করবে কিনা। তাছাড়া প্র‍্যাংক কলের ইউজারদের বেশিরভাগ ছিল কিশোর, তাদের হাতে খুব বেশি টাকা থাকেও না। কিন্ত ফাহিমকে অবাক করে দিয়ে প্রতিদিন গড়ে বিশ ডলার করে অ্যাকাউন্টে ঢুকতে শুরু করলো হুড়হুড় করে। উৎসাহী হয়ে ফাহিম সেখানে অডিও'র পরিমাণ বাড়ালেন, ইউজারও বেড়ে গেল। বিশ থেকে শুরু হয়ে প্রতিদিন একশো-পাঁচশো এমনকি হাজার ডলারও আসা শুরু হলো। কয়েক বছরের মাথায় ফাহিম প্রায় এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করলেন এই প্র‍্যাংক কল সার্ভিস থেকে। তরুণ বয়সে তিনি যেসব প্রোজেক্টের পেছনে বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোর টাকা এসেছে এই প্র‍্যাংক কল সার্ভিস থেকেই।

পাঠাওয়ের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার একজন এই ফাহিম সালেহ। তবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় খুব বেশি মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন না। ২০১৪ সালে একবার দেশে এসেছিলেন ফাহিম। ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে। ২০১৫ সালে যখন বাইক রাইড শেয়ারিং নিয়ে কারো তেমন কোন ধারণাই ছিল না, তখন মাত্র ১০০টি বাইক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল পাঠাও। সেই পাঠাও এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাইড শেয়ারিং কোম্পানী। প্রায় ১ লক্ষ রাইডার কাজ করেন পাঠাওয়ে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কোম্পানিটির বর্তমান মূল্যমান, কয়েক'শ কোটি ইনভেস্টমেন্ট। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- পাঠাওয়ের আগমণের কারণে অজস্র মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছে। বেকার যুবকরা রাউড শেয়ারিংয়ে নাম লিখিয়েছে, মোটর সাইকেলের বিক্রিও বেড়েছে, প্রায় দ্বিগুণ।

পাঠাওয়ের সাফল্যের পর ফাহিম নাইজেরিয়াতে গোকাডা এবং কলম্বিয়াতে পিকআপ নামে আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করেন। সেখান থেকেও ভালো পরিমাণের রেভিনিউ অর্জন করতে সক্ষম হন তিনি। আফ্রিকার বড়সড় বাজারটাকে ধরার প্ল্যান ছিল ফাহিমের, সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। নাইজেরিয়ায় চালু করা গোকাডা সেদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ছিল। ফাহিমের স্বপ্ন ছিল- রাইড শেয়ারিং অ্যাপসকে ভিন্নমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু আভ্যন্তরীণ কিছু চাপের কারণে নাইজেরিয়া সরকার ফাহিমের গোকাডা রাইড সার্ভিসটি বন্ধ করে দেয়। তখন ফাহিম সেটিকে পার্সেল সার্ভিসে পরিণত করেন। তবে বন্ধ হবার আগে এক বছরে গোকাডা থেকে ফাহিমের আয় হয়েছিল ৫৩ লাখ ডলারেরও বেশি! ফাহিমের মৃত্যুর সঙ্গে এই ব্যাপারটার একটা সংযোগ থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। নাইজেরিয়ার লাগোস শহরের মাফিয়ারা ফাহিমের এই ব্যবসাটাকে ভালো চোখে দেখছিল না। সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তারাই গোকাডা'র রাইড সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে করতেন ফাহিম। নিজের বাবার সঙ্গে কথাবার্তায় তিনি একবার বলেছিলেন, 'নাইজেরিয়ানদের ব্যবহার খুব খারাপ। আর তাদের সাথে ব্যবসা করাটাও কঠিন।'

প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ফাহিমের পরিচয় ছিল 'বাংলাদেশী ইলন মাস্ক' নামে। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সাহসী ছিলেন, ঝুঁকি নিতে ভয় পেতেন না কখনও। তাই তো নাইজেরিয়া থেকে নেপাল বা কলম্বিয়া- ছুটে গেছেন সব জায়গায়। নতুন কোন উদ্যোগ তার পছন্দ হলে সেটার পাশে দাঁড়াতেন সাধ্যমতো। বাংলাদেশেই যেমন জোবাইক এবং যাত্রীতে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। নিজে যা জানতেন সেগুলো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মজা করতেন ভীষণ। অল্প বয়সে দারুণ খ্যাতির দেখা পেয়েছেন কিন্ত অহংকার তাকে গ্রাস করতে পারেনি।

ফাহিম সালেহ হয়তো বাস্তবের মার্ক জাকারবার্গ হতে পারতেন, ইলন মাস্ক হতে পারতেন। কিন্ত তিনি হয়ে গেলেন লাশ, শরীরের খণ্ড-বিখণ্ড টুকরোগুলো নিয়ে তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে রইলো ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। যে ফ্ল্যাটটা বছরখানেক আগেই আড়াই মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনেছিলেন তিনি। যেখানে বসে নিজের সৃজনশীল আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবতেন ফাহিম। ফাহিমের এই অকাল মৃত্যুতে পৃথিবীর কি ক্ষতি হয়েছে জানিনা, তবে বাংলাদেশ হারালো তার এক রত্নকে। এমন মেধাবী উদ্যোক্তা যত্রতত্র পাওয়া যায় না যে। ফাহিম সালেহরা যুগে যুগে জন্মান না। ফাহিমের মতো কাউকে পেতে হলে বাংলাদেশকে কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, সেটা কেউ জানে না...!

এদিকে, পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার ব্যক্তিগত সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে নিউইয়র্কের পুলিশ। স্থানীয় সময় শুক্রবার (১৭ জুলাই) ভোরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ফাহিম হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হচ্ছে। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, ফাহিম সালেহর বোন যখন ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছিলেন, হত্যাকারী তখন লাশ টুকরা করছিলেন।

মার্কিন দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস দুজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এ কথা জানিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নাম টেরেস ডেভোন হাসপিল। ২১ বছর বয়সী এই তরুণের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে। টাইরেস ডেভোন হ্যাসপিল, একজন আমেরিকান নাগরিক। তিনি ফাহিমের সহকারীও ছিলেন। ফাহিমের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট থেকে লক্ষাধিক ডলার চুরি করেছিল এই টাইরেস। বিষয়টি জেনে ফেলেছিলেন ফাহিম। সেই অর্থ ফেরত দেওয়ার একটি সমঝোতা করে টাইরেস ফাহিমের ফার্ম ছেড়েছিল। তবে পরবর্তীতে টাইরেস চুরি করা অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার পালন করেনি।

তদন্ত কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন- ফাহিমকে অনুসরণ করে নিনজা স্টাইলে কালো পোশাকে যে ব্যক্তি ওই ভবনের এলিভেটর দিয়ে ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পর্যন্ত গিয়েই আঘাত করেছে বলে সিসিটিভিতে দেখা গেছে, সেই ব্যক্তি অর্থাৎ ঘাতকটি হচ্ছে টাইরেস। আর্থিক ফায়দা হাসিলের জন্যই ফাহিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন। তবে এমন নৃশংসতার নেপথ্যে কারও মদদ রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, ফাহিম সালেহকে স্থানীয় সময় সোমবার কোনো এক সময়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী ওই দিন চলে যাওয়ার পরদিন মঙ্গলবার আবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন। এরপর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে মরদেহ টুকরো করে বড় আকারের ব্যাগে ভরে ফেলেন। হত্যার আলামত মুছে ফেলারও চেষ্টা করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকারী যখন ফাহিম সালেহর শরীর টুকরা টুকরা করে ব্যাগে ভরছিলেন, তখন তাঁর বোন ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছিলেন। অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে পৌঁছালে হত্যাকারী বিষয়টি টের পান, তখন অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের দরজা ও সিঁড়ি দিয়ে হত্যাকারী বেরিয়ে যান।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি