ঢাকা, সোমবার   ১০ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: নম্রতার পথে যুক্তরাষ্ট্র?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:১৫, ২০ মার্চ ২০২২

Ekushey Television Ltd.

যে দেশটি এ শতাব্দীতে একটি নয় দু-দুটো দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান বিভীষিকার পরও সেই দেশ এখনও মুখে যুদ্ধে জড়ানোর কথা বলছে না।

যে দেশ ইরাকে যুদ্ধের সময় 'শক অ্যান্ড অ' অর্থাৎ রক্ত পানি করা হামলার চালানোর হুমকি এবং সে মত কাজ করেছিল তারাই এখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সতর্ক আচরণ করছে।

বিকল্প কোনো পথ কি আমেরিকার কাছে আছে যেটা তাদের স্বার্থ হাসিল করবে?

নিজে উদ্যোগ নিয়ে শুক্রবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দু'ঘণ্টা ধরে কথা বলার ভেতর দিয়ে প্রমাণ হয় ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানো আমেরিকার জন্য কতটা কঠিন।

চীনের ওপর আমেরিকার প্রভাব খুবই কম। ঐ বৈঠক নিয়ে দুই পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তাতে মনে হয় না দুই ঘণ্টার টেলিফোনে কাজ কিছু হয়েছে। কিন্তু তার ক্ষমতার প্রথম বছরে বাইডেন যে মনোভাব দেখিয়েছেন তার চেয়ে এখন তিনি যা করছেন তা অনেকটাই আলাদা। কূটনীতি এখন তার ধ্যানজ্ঞান।

মিত্রদের সাথে দূরত্ব
আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে গত বছর যে টালমাটাল অবস্থা হয়েছিল তাতে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অনেকটাই পোড় খেয়েছে।

কাণ্ড দেখে তখন মনে হয়েছে মার্কিন গোয়েন্দাদের কোনো প্রস্তুতি ছিলনা, এবং যেভাবে কাবুল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার হয়েছে তার পেছনে অব্যবস্থা আর অযোগ্যতার ছাপ ছিল স্পষ্ট।

সবচেয়ে বড় কথা - ইউরোপীয় কূটনীতিকরা সেসময় অভিযোগ করেন যে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়ে তাদেরর সাথে কথাই বলেনি।

আমেরিকা তার ইচ্ছামত আকস্মিক সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে দেয়। ফলে অন্য যেসব ন্যাটো দেশের সৈন্য বা তাদের নাগরিকরা আফগানিস্তানে ছিল তাদেরকে মূহুর্তের সিদ্ধান্তে পড়িমরি করে বেরুনোর পথ নিতে হয়।

কিছু দেশ তখন বলেছিল কিছু ন্যাটো সৈন্য আফগানিস্তানে রেখে যাওয়া উচিৎ। আমেরিকা তাতে কানও দেয়নি। আফগানিস্তান নিয়ে সেই একরোখা আচরণ দেখিয়েই প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে থেমে গিয়েছিলেন তা নয়।

সেপ্টেম্বর মাসে হোয়াইট হাউজ হঠাৎ করে ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে একটি পারমাণবিক সাবমেরিন নিরাপত্তা জোট তৈরির ঘোষণা দেয়।

আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার অবস্থা হয় ফ্রান্সের। কারণ তারা যে সাবমেরিন বহর বিক্রির চুক্তি অস্ট্রেলিয়ার সাথে করেছিল সেটি ভেস্তে যায়। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর অফিস থেকে বলা হয় 'অকাস' নামে এই জোট তৈরির কথা তারা খবরের কাগজে পড়ে জানতে পারে।

সবচেয়ে পুরনো একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার ঐ আচরণ ছিল নজিরবিহীন।

প্রচণ্ড ক্ষেপে যান ফরাসী প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য পরে দু:খ প্রকাশ করেন এবং স্বীকার করেন নতুন জোট নিয়ে মিত্রদের আগে থেকে না জানানো তার ঠিক হয়নি। কিন্তু সম্পর্কের যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে হয়ে যায়।

গত বছর শরৎকালের মধ্যে ইউরোপীয়রা বাইডেন প্রশাসনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে। তারা ধরেই নেয় ট্রাম্প বিদায় হওয়ার পর আমেরিকার আচরণে পরিবর্তনের যে আশা তাদের ছিল সেই গুড়ে বালি।

সেই অবিশ্বাস থেকেই হয়তো ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে আমেরিকা দেওয়া ঘন ঘন সতর্কবার্তায় ইউরোপীয় দেশগুলো দেশ কান দিচ্ছিল না। এ নিয়ে আমার সাথে কথা বলার সময় একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেছিলেন, "যুদ্ধবাজি আচরণ।"

আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা হোক বা বর্তমান পরিস্থিতির ভিন্ন বাস্তবতার কারণেই হোক, ইউক্রেন সংকটকে হোয়াইট হাউজ আগের বহু সংকটের চেয়ে ভিন্নভাবে সামলানোর চেষ্টা করছে।

শুরু থেকেই আমেরিকা তার মিত্রদের সাথে শলাপরামর্শ করছে। ভেতর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে এসব শলা পরামর্শের সময় আমেরিকানরা ইউরোপীয় মিত্রদের অধস্তন বা লেজুড় হিসাবে বিবেচনা না করে তাদের সম-মর্যাদার মিত্র হিসাবে বিবেচনা করছে।

যেভাবে তাদের সাথে আমেরিকানরা অত্যন্ত গোপন এবং স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করছে তা নজিরবিহীন।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা ইউরোপীয় দেশগুলোর একাধিকবার সফর করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন অনেক ইইউ নেতাকে সাথে নিয়মিত ফোন করেছেন।

হোয়াইট হাউজের বর্তমানের এই আচরণ ২০০২ সালে ইরাক নয়। ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' স্লোগান নয়। এটা ২০২১ সালের আফগানিস্তান নয়। বরঞ্চ সত্যিকারের জোট গঠনে আমেরিকার কাছ থেকে যে চেষ্টা, উদ্যোগ এবং আকুতি চোখে পড়ছে তা ভিন্ন।

জার্মান ট্রাম্প কার্ড
জানুয়ারির ২৭ তারিখে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় আমেরিকার এই 'শাটল ডিপ্লোম্যাসি' কাজে দিচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর এক মাস আগে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ ৭ই ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন সফরে আসবেন।

সবে ক্ষমতা নেওয়া জার্মান চ্যান্সেলরের ঐ সফর থেকে ইঙ্গিত মিলছিলো বাইডেন প্রশাসন হয়তো বুঝতে পারছিল ইউক্রেন পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে এবং তার জন্য কী করা জরুরী : জার্মানির সহযোগিতা।

হোয়াইট হাউজ সফর যে কোনো দেশের নেতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রাপ্তি। এটা কিছুটা ঠিক যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির শক্তিশালী বার্তায় জার্মানরা নড়ে বসছিল, কিন্তু জার্মানির নীতি পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে আমেরিকান কূটনীতি।

আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, আর তা হলো , ওয়াশিংটনের সামরিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যে নতুন উপলব্ধির জন্ম। তারা মনে করছে যত শক্তিধরই মার্কিন সেনাবাহিনী হোক না কেন তা দিয়ে সবকিছু অর্জন করা সম্ভব নয়।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের মধ্যে এই উপলব্ধি নতুন এবং কিছুটা অস্বাভাবিক।

সাদ্দাম হোসেন যখন ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করেন, সৈন্য পাঠানোর জন্য আমেরিকা প্রায় সারা পৃথিবীর কাছ থেকেই প্রায় জোর করে সমর্থন আদায় করেছিল। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন কসোভোতে ন্যাটো বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

নাইন-ইলেভেনের পর ইরাকে সামরিক অভিযানের জন্য প্রায় জবরদস্তি করে একটি সামরিক কোয়ালিশন তৈরি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ। ২০১১ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারকে উৎখাতের অভিযানে যোগ দিয়েছিল আমেরিকা।

কিন্তু এখন আমেরিকা ধৈর্য ধরার পথ নিয়েছে। যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির আবেগি বক্তব্য বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখনও টলছেন না। বড়জোর তিনি ইউক্রেনের অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। সাইবার প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন। সাময়িকভাবে এর চেয়ে তিনি অন্য কিছু করবেন তা মনে হচ্ছেনা।

আমেরিকানরা জানে ইউক্রেনে নো-ফ্লাই জোন দেয়া এবং তা কার্যকর করার ক্ষমতা হয়তো তাদের রয়েছে। তা করতে প্রয়োজনীয় যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং সুদক্ষ পাইলট তাদের রয়েছে।

কিন্তু হোয়াইট হাউজ বার বার বলছে, আমেরিকান সামরিক শক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেও যুদ্ধ হয়তো থামানো যাবেনা। বরঞ্চ তাতে পরিস্থিতির অবনতি হবে।

আমেরিকা এই যুদ্ধে যত বেশি অংশ নেবে, প্রেসিডেন্ট পুতিন তত বেশি নিজের দেশের জনগণকে বোঝাতে সমর্থ হবেন যে এই যুদ্ধ আসলে রাশিয়া এবং আমেরিকার লড়াই। যে কারণে হোয়াইট হাউজ মস্কোতে ক্ষমতা পরিবর্তন বা রাশিয়ায় গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করছে না।

দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধ যখন তুঙ্গে সেসময় ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা আরেকবার পড়ছিলাম। সেসময় মার্কিন বিদেশ নীতির নিয়ন্ত্রণ কট্টর ডানপন্থী কিছু লোকের হাতে।

"প্রতিটি সমাজে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমর্থন এবং তার সাফল্যের প্রতি সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। আর এর মূল লক্ষ্য - পৃথিবী থেকে স্বৈরশাসন নির্মূল," প্রেসিডেন্ট বুশ তার ভাষণে বলেছিলেন।

স্পষ্টই তা ছিল আমেরিকান ঔদ্ধত্য। তবে হোয়াইট হাউজ জানে লক্ষ্য এবং শক্তি প্রয়োগের ইচ্ছা জাহির না করারও ঝুঁকি অনেক।

আমেরিকা মনে করছে ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে চুপ থাকলে মৃত্যুর মিছিলে লোক বাড়তেই থাকবে, এবং রাশিয়া নেটো জোটের কোনো দেশেও হামলা চালিয়ে বসবে।

কিন্তু সেই সম্ভাবনা রোখার জন্য বড় কোনো সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য সর্বনাশা পরিণতির কথাও আমেরিকার মাথায় রয়েছে। আমেরিকা জানে সমাধান সহজ নয় এবং সে কারণেই খুব সাবধানে হাঁটছে হোয়াইট হাউজ। সূত্র: বিবিসি

এসি
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি