ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

পুতিনের জন্য অপেক্ষা করছে হিটলারের পরিণতি?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১৭, ৩ এপ্রিল ২০২২

Ekushey Television Ltd.

অ্যাডলফ হিটলার বার্লিনে নিজের বাঙ্কারে মাথায় গুলি করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। ৭৭ বছর পর বিশ্ব রাজনীতিতে ‘দ্বিতীয় হিটলার’ বলে পরিচিতি পাওয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়েও ইদানিং একটি প্রশ্ন উঠছে। ইউক্রেনের যুদ্ধের শেষে তারও কি একই পরিণতি হতে চলেছে!

দিনটি ছিল ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। তত দিনে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন অধিকারের স্বপ্ন মাথায় উঠেছে। পাল্টা রুশ সেনারাই ঘিরে ফেলেছে হিটলারের গোপন ডেরা। শত্রুর হাতে তার ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত। সেই অপমানের হাত থেকে রেহাই পেতে আত্মঘাতী হয়েছিলেন হিটলার। ২০২২ সালের এ-ও এক এপ্রিল মাস। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার দ্বিতীয় মাস। 

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুতিনকেও না অচিরেই নিজের ছোড়া তীর নিজেকেই বুক পেতে নিতে হয়।

কেন এই প্রশ্ন? হিটলারের সঙ্গে পুতিনের কিসের মিল! বিশেষ করে যে নাৎসিদের পুতিন কার্যত ঘৃণা করেন, যে হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণের দৌলতে পুতিন তার পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, যেখানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার যুক্তি হিসেবে তিনি ইউক্রেনকে নাৎসিপন্থী বলে দেগে দিতে দ্বিধা করেননি, সেই নাৎসি নেতা হিটলার এবং পুতিনের পরিণতি কেন এক হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে! আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, মুখে নাৎসিদের নিন্দা করলেও আদতে কাজে অবিকল জার্মান একনায়ককেই অন্ধ অনুকরণ করছেন পুতিন।

ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, এই অনুকরণই কাল হতে চলেছে পুতিনের। পুতিন না কি সেই ভুলগুলিই অবিকল করে চলেছেন যা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সময় হিটলার করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সমস্ত সিদ্ধান্ত হিটলারের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিল বলে মনে করা হয়, ইউক্রেনের যুদ্ধেও পুতিন সেগুলিই ক্রমাগত করে চলেছেন।

পুতিনকে যারা জানেন, চেনেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত ছিল অযৌক্তিক। অথচ পুতিন যে ধরনের ঠান্ডা মাথার মানুষ তাতে এই অযৌক্তিকতা তার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। রাশিয়া বিশেষজ্ঞ এক ইতিহাসবিদ পিটার টি ডিসিমোনের কথায়, ‘‘পুতিন যে রকম ভয়ঙ্কর মানুষ, তাতে তিনি যুক্তি-বুদ্ধিহীন কাজ করবেন এটা ভাবা যায় না। কিন্তু ওঁর কাজ বলছে, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ তিনি প্রায়ই বিভিন্ন প্রসঙ্গে টেনে আনেন, সেই যুদ্ধ থেকে তিনি কোনও শিক্ষাই নেননি।’’

পিটার বলেছেন, গত এক মাস ধরে আমি ওর সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেও পাইনি।’’ পুতিনের নেওয়া এর আগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তুলনা টেনে পিটার বলেছেন, ‘‘পুতিন অতীতে যা করেছেন তার সঙ্গে ওঁর এখনকার কাজকর্মের কোনও মিলই নেই। আর এই অমিলটি যত স্পষ্ট করে চোখে পড়ছে, তত ভয় হচ্ছে।’’

পুতিন ঠিক কী কী ভুল করেছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা! তারা বলছেন পুতিন যুদ্ধের সাধারণ নিয়মনীতিগুলিই মানছেন না। তিনি যুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন, এ দিকে সেনাবাহিনীর জন্য যে সরবরাহ প্রয়োজন, তার যোগানের ব্যবস্থা রাখেননি। হিটলারের সঙ্গে তুলনা টেনে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান একনায়কও এই একই ভুল করেছিলেন। বস্তুত সোভিয়েত দখল করতে এসে জার্মান বাহিনীর পতনের একটি বড় কারণও ছিল সেটিই।

যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিটলারের হাতে সেই সময় যে অস্ত্র আর সেনা ছিল তাতে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সোভিয়েত জয় করতে তার বেশি সময় লাগবে না। ঠিক যেমন পুতিন ভেবেছিলেন তিনি এক সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেন দখল করে নিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে দু’জনেই ভুল প্রমাণিত হয়েছেন।

ইউক্রেনের যুদ্ধ এত দীর্ঘ দিন ধরে চলবে তা আন্দাজ করতে পারেননি পুতিন। ফলে তার ট্যাঙ্ক বাহিনীর জন্য জ্বালানি প্রস্তুত ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের যে ট্যাঙ্ক বাহিনীকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন সেনারা, সেই ট্যাঙ্ক বাহিনী ইউক্রেনের যুদ্ধে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। তার অবশ্য দু’টি কারণ। প্রথমত ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী অস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইউক্রেন সেনারা। আর যেগুলি বেঁচে আছে সেগুলি জ্বালানির অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে দ্রুত। ঠিক যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ট্যাঙ্কের জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছিল হিটলারবাহিনী।

যুদ্ধক্ষেত্রে সরবরাহ পৌঁছনোর পরিকল্পনার অভাবের আরও একটি গুণাগার দিতে হয়েছিল হিটলার বাহিনীকে। সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে পাঠালেও তাদের শীতবস্ত্র দিতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। শেষে রাশিয়ার ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে প্রায় আড়ই লক্ষ জার্মান সৈনিক মারা যান। অথবা ফ্রস্টবাইটে আক্রান্ত হন।

দুই রাষ্ট্রনেতার ভুলের মিল দেখিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধে অপোক্তরাই যুদ্ধনীতি নিয়ে ভাবেন। তবে যাঁরা দূরদর্শী তারা প্রথমে ভাবেন যুদ্ধের সরবরাহ নিয়ে।

তবে সরবরাহ নীতির ব্যর্থতা ছাড়াও আরও ভুল করেছেন পুতিন। তার পরের ভুলটি হল ইউক্রেনে থাকা রাশিয়ার সমর্থকদের দূরে ঠেলে দেওয়া। কী ভাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মুহূর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে একটিই আবেগ কাজ করছে। আর তা হল, ঘৃণা। যে ভাবে ইউক্রেনের হাসপাতাল, শপিংমলে বোমা ফেলেছে রাশিয়া, বসতি এলাকাগুলিকে বিস্ফোরণে ছারখার করে দিয়েছে, তাতে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে গিয়েছেন ইউক্রেনের মানুষ। এমনকি তারাও এখন রাশিয়ার বিরদ্ধে চলে গিয়েছেন যাঁদের আত্মীয়রা রাশিয়ায় আছেন। এঁরা প্রাথমিক ভাবে রাশিয়ারই সমর্থক ছিলেন।

কিছু দিন আগেই ইউক্রেনের এক অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলার ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে রুশ হামলায় জখম ওই মহিলাকে পূর্ণ গর্ভাবস্থায় একটি খোলা ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার পোশাকের অনেকটাই উন্মুক্ত। দেখা যাচ্ছে পেটের অনেকটা অংশ। তা থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত। হবু সন্তানকে বাঁচানোর আশায় ওই মহিলা দু’হাতে আগলে রেখেছেন পেটের একটি অংশ। পরে ওই মহিলা এবং তার সন্তান দু’জনেই মারা যান। 

ইউক্রেনের রাজনীতিকরা জানিয়েছেন, ওই দৃশ্যটি যে ভাবে গোটা ইউক্রেনকে জোটবদ্ধ করেছে তা এর আগে কখনও হয়নি। পুতিনের বিরুদ্ধে এখন ইউক্রেনের সমস্ত বাসিন্দার মনে শুধুই তিক্ততা।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্রাছাড়া হিংসা অনেক সময়েই বিপদ ডেকে আনে। পুতিনেরও তাই হয়েছে। এই একই ভুল হিটলারও করেছিলেন। প্রথম দিকে সোভিয়েতের অনেকেই হিটলারকে মুক্তিদাতা ভেবে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কেন না তারা সেই সময়ের শাসক স্টালিনের অত্যাচার থেকে মুক্তি চাইছিলেন। ইউক্রেনের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ সে সময় অভুক্ত থেকে মারা গিয়েছিলেন স্তালিনের নীতির দৌলতে। কিন্তু তারাই যখন দেখলেন, হিটলারও দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছেন, তখন হিটলারের বিরুদ্ধে চলে যান তাঁর সমর্থকরা।

হিটলারের যুদ্ধের বক্তৃতায় ব্যবহৃত শব্দের সঙ্গে পুতিনের কথাবার্তারও মিল পেয়েছেন অনেকে। এমনকি বিশেষজ্ঞরা এমনও দাবি করেছেন যে, হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেই কেম্ফ’ থেকে লাইনও বহু বার উঠে এসেছে পুতিনের বক্তৃতায়। হিটলার জার্মানির পুরনো ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতেন। এমনকি যুদ্ধের পর জার্মানির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার কথাও বলতেন। পুতিনও জানিয়েছেন, রাশিয়ার পুরনো এবং ভাল সময় নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে তাঁদের ইউক্রেনকে চাই।

হিটলারের বক্তব্য ছিল, জনতাকে মিথ্যে বোঝাতে হলে তা এত বড় মিথ্যে হওয়া উচিত যে তারা ভাবতেই না পারেন, ওই মিথ্যে কেউ তাদের বলতে পারে। ঠিক যেমন পুতিন রাশিয়াকে বুঝিয়েছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ আসলে নাৎসি নিকেশ করার লক্ষ্যে। অথচ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি একজন ইহুদি। হলোকাস্টের সময় যখন ইহুদিদের গণহত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী তখন জেলেনস্কির পরিবারের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন।

তবে হিটলারের সোভিয়েতে অনুপ্রবেশের ফল সবার জানা। নাৎসিরা নিজেদের যুদ্ধনীতির ভুলে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৫ সালে রুশ বাহিনী ঘিরে ফেলে জার্মান একনায়কের গোপন ডেরা। মৃত্যু হয় হিটলারের।

ইউক্রেনের যুদ্ধ কী ভাবে শেষ হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। হয়তো পুতিন শেষমেশ জয়ী হবেন। তবে যদি ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিতে যায়, তবে এটি নিঃসন্দেহে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তখন বিশ্বের দরবারে মুখ লুকনোর জায়গা পাবেন না পুতিন। তখন তাকেও না হিটলারের মতোই কোনও মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সূত্র: আনন্দবাজার

এসি
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি