ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ইউক্রেনে এখন বিধ্বংসী মার্কিন রকেট কেন? কী করবে রাশিয়া?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৬, ২ জুন ২০২২

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মাস-খানেকেরও বেশ সময় ধরে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে এবং বিভিন্ন সূত্রে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে যে দ্রুত বহনযোগ্য দূরপাল্লার রকেটের মত অত্যাধুনিক অস্ত্র যেন ইউক্রেনকে না দেয়া হয়, এবং দিলে 'অপ্রত্যাশিত পরিণতি' ভোগ করতে হবে।

এমনকি গত সপ্তাহে জার্মান চ্যান্সেলর শোলৎজ এবং ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর সাথে এক ত্রি-পক্ষীয় ভিডিও বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজে ইউক্রেনকে এমন অস্ত্র না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেন।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন শেষ পর্যন্ত তা অগ্রাহ্য করলেন।

বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যেসব অস্ত্র আমেরিকা এবং ন্যাটো জোটের দেশগুলো থেকে ইউক্রেনকে দেয়া হয়েছে, সেগুলার তুলনায় আমেরিকার তৈরি এম-১৪২ হাই মবিলিটি আর্টিলারি সিস্টেম (এইচএমএআইএস ) রাশিয়ার জন্য অনেক বেশি হুমকি তৈরি করবে।

এই কামান দ্রুত স্থানান্তর করা যায়, এর পাল্লা ৫০ মাইলের মত এবং এত দূরের টার্গেটকেও নিখুঁতভাবে এই আর্টিলারি সিস্টেম দিয়ে টার্গেট করা যায় - কারণ এটি জিপিএস নিয়ন্ত্রিত। অস্ত্র বিশেষজ্ঞেরা বিশ্বাস করেন, একই ধরণের যে অস্ত্র রাশিয়ার কাছে রয়েছে, তার চেয়ে আমেরিকান অস্ত্র অপেক্ষাকৃত জুতসই এবং অব্যর্থ।

ডনবাসে গেম চেঞ্জার?
বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামস বলছেন যে ডনবাসে রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের সৈন্যরা যে চরম চাপে পড়েছে, মার্কিন এই অত্যাধুনিক আর্টিলারি সিস্টেম পৌঁছুলে সে চিত্র বদলে যেতে পারে।

যে সব কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে রাশিয়া ডনবাসে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, যেসব জায়গার অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে অস্ত্র রণাঙ্গনে পাঠাচ্ছে কিংবা যেখানে যেখানে দূর-পাল্লার কামান বা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করছে, ইউক্রেন এখন সেসব জায়গা টার্গেট করতে পারবে।

সন্দেহ নেই মার্কিন এই অস্ত্র হাতে পেলে রণক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বাড়বে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন তার মূল্য লক্ষ্য ভবিষ্যতে রাশিয়ার সাথে আপোষ মীমাংসায় ইউক্রেনের হাত শক্ত করা। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এতে মীমাংসা ত্বরান্বিত হওয়ার বদলে যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার সমূহ ঝুঁকি তৈরি হবে।

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং যুদ্ধবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, আমরা এরই মধ্যে দেখেছি ইউক্রেন কয়েকবার রাশিয়ার অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালিয়েছে। নতুন মার্কিন অস্ত্র পেলে সেই সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। 

মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে মার্কিন একাধিক নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে যে রাশিয়ার অভ্যন্তরে এই রকেট ছোড়া হবে না - ইউক্রেনের কাছ থেকে এমন আশ্বাস পাওয়ার পরই তা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

রাশিয়ার অনেক ভেতরে হামলার সম্ভবনা
ইউক্রেনকে কেন এই অস্ত্র তিনি দিচ্ছেন সেই যুক্তি তুলে ধরতে বুধবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে কলাম লিখেছেন, সেখানে তিনি রাশিয়াকে বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি লেখেন, "আমরা ইউক্রেনকে বলছি না যে তারা তাদের সীমান্তের বাইরে এই অস্ত্র ব্যবহার করুক।"

প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রসঙ্গ তুলে বাইডেন লিখেছেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনও লক্ষ্য আমেরিকার নেই।

"পুতিনের সাথে আমাদের যতই মতবিরোধ থাকুক, তার আচরণকে আমরা যতই অপছন্দ করি না কেন, আমরা ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চাই না। আমরা পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও চাই না," বলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

মার্কিন একটি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন যে রাশিয়ার ভেতর হামলার কোন ইচ্ছা তাদের নেই। নিউজম্যাক্স চ্যানেলকে তিনি বলেন, "রাশিয়ার অভ্যন্তরে কী হচ্ছে তা নিয়ে আমরা উৎসাহী নই। আমরা শুধু ইউক্রেনের অভ্যন্তরে কী হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত।"

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কথা রাশিয়াকে কতটা আশ্বস্ত করবে?

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত জানার সাথে-সাথেই রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিবাকভ বলেন, "আত্মসংযমের" এসব কথা "অর্থহীন।" সরকারি বার্তা সংস্থা আরআইএকে তিনি বলেন, "আসল কথা আমেরিকা কিয়েভ সরকারের কাছে কাড়ি কাড়ি অস্ত্র পাঠাচ্ছে...। অন্যান্য প্রসঙ্গ অবতারণার কোন অর্থ আমাদের কাছে নেই।"

ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, কোন অস্ত্র কোথায় ব্যবহার হবে আর হবে না, যুদ্ধের সময় এমন অঙ্গীকার অবাস্তব।

"জেলেনস্কি যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন না। এই অস্ত্র যদি সীমান্ত এলাকার রণাঙ্গনে পৌঁছে, এবং ইউক্রেনিয়ান সৈন্যরা যদি প্রচণ্ড চাপে পড়ে বিপর্যস্ত হয়, তখনও আমেরিকার এই অস্ত্র হাতে থাকা সত্বেও তা দিয়ে তারা রাশিয়ার ভেতরে হামলা করে বসবে না- এমনটা ভাবা একবারেই বোকামি," বলেন ড. আলী।

"যুদ্ধক্ষেত্রে কোন কিছু আগে থেকে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব।"

যুদ্ধ বিস্তারের ঝুঁকি
ক্রাইমিয়াকে এবং ডনবাসের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাকেও ইউক্রেন তাদের অংশ বলেই মনে করে। সেসব জায়গায় দূরপাল্লার এই অস্ত্র ব্যবহার করে তারা বলতেই পারে এই হামলা তারা আত্মরক্ষার্থে করছে।

বিপদ সেখানেই, মনে করেন ড. আলী। রাশিয়ার অভ্যন্তরে বড় কোন হামলা হলে এবং তাতে ধ্বংসযজ্ঞ বা প্রাণহানি হলে নিশ্চিতভাবে রাশিয়া তার বদলা নেয়ার চেষ্টা করবে।

তেমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার কাছ থেকে কোন ধরনের সাড়া দেখা যেতে পারে?

ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, রাজধানী কিয়েভ-সহ ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত অংশে রাশিয়া নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা শুরু করতে পারে।

"রাশিয়া সব সময় বলেছে ইউক্রেন দখল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। সেই ক্ষমতাও তাদের রয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত শহরগুলাতে নতুন করে বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করতে পারে তারা। বিশেষ করে কিয়েভকে তারা টার্গেট করতে পারে।"

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক আভরিল হেইন্স সম্প্রতি সেনেটের সেনাবাহিনী বিষয়ক স্থায়ী কমিটির এক শুনানিতে বলেছেন যে আগামী কয়েকটি মাসের পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে থাকতে পারে যখন, তার মতে, যুদ্ধের "গতি-প্রকৃতি অনুমান করা কঠিন হতে পারে এবং যুদ্ধ বিস্তৃতি লাভ করতে পারে।"

রাশিয়ার ট্যাকটিক্যাল পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকির কথাও তিনি তুলে ধরেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।

বুধবার যে পত্রিকায় লিখে বাইডেন ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ার যুক্তি তুলে ধরেছেন সেই নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ড গত সপ্তাহে তাদের দীর্ঘ এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ইউক্রেনকে সাহায্য করার লক্ষ্য থেকে আমেরিকার সরে যাওয়া উচিৎ নয় ঠিকই, তবে "রাশিয়ার সাথে সর্বাত্মক একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও আমেরিকার স্বার্থের পক্ষে নয়।"

তারপরও ইউক্রেনকে এমন সব স্পর্শকাতর অস্ত্র কেন দিচ্ছেন বাইডেন, যেসব অস্ত্র যুদ্ধকে এক অনিশ্চিত পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে?

ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, ডনবাসে যে বিপর্যয়ে ইউক্রেন পড়েছে তা থেকে তাদের উদ্ধার করার একটা চেষ্টা হয়তো আমেরিকা করছে।

তিনি বলেন, "পূর্বে ডনবাস এবং দক্ষিণের বেশ কিছু এলাকায় ইউক্রেন প্রচণ্ড চাপে পড়েছে। এ অঞ্চলের যেসব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার লক্ষ্য রাশিয়া নিয়েছিল তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ তারা দখলে নিয়ে নিয়েছে। এবং আমি মনে করি আগামী ১০ দিনের মধ্যে তারা লক্ষ্য অর্জন করে ফেলবে।

"এই পরিস্থিতি সামলানোর জন্যই আমেরিকা এখন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।"

আমেরিকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা - পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং মার্কিন পার্লামেন্টের প্রভাবশালী স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি - বলেছেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া কোনওভাবে বিজয়ী বোধ করুক, তা আমেরিকা দেখতে চায় না।

ড. আলীর মতে, মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের কথায় সরকারের নীতি প্রকাশ করেছেন।

"আমেরিকার মূল লক্ষ্য ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিকভাবে এমনভাবে দুর্বল করে ফেলা, যাতে বহুদিন পর্যন্ত তারা ইউরোপে ন্যাটো দেশগুলোর ওপর কোনও ধরনের হামলা চালানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।"

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে এই যুদ্ধ যতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে ততদিন আমেরিকার জনগণ ধৈর্য ধরে রাখবে কিনা? ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী কোন যুদ্ধ জার্মানি এবং ফ্রান্সের মত এই মহাদেশের প্রধান শক্তিধর দেশগুলো গ্রহণ করতে রাজী কিনা?

এবং সর্বোপরি এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে যে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে, তা সামাল দেওয়া আমেরিকার জন্য সম্ভব হবে কিনা? সূত্র: বিবিসি

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি