কেন, কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বেলুচ তরুণরা?
প্রকাশিত : ১৯:১৮, ৭ জুলাই ২০২২ | আপডেট: ১৯:৩১, ৭ জুলাই ২০২২
লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সামির চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কোচ জেলার তুরবাত এলাকা থেকে উধাও হয়ে যান। মোহাম্মদ বখশের ছেলে সামির তুরবাতে গিয়েছিলেন বেড়াতে। এখনও খোঁজ মেলেনি সামিরের।
ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এমফিলের শিক্ষার্থী হাফিজ বালুচকে তার নিজ এলাকা খুজদার থেকে অজ্ঞাত কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। আজও ফেরেননি হাফিজ।
২৭ ফেব্রুয়ারি একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পাঞ্জাব থেকে কোয়েটা যাওয়ার পথে হাওয়া যান বাহওয়ালপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র দিলীপ বালুচ। বেলুচিস্তানের বারখানের বাসিন্দা ছিলেন দিলীপ।
বেলুচ তরুণ শিক্ষার্থীদের এমন হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু না; যা চলছে এখনও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে, পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকেরা এভাবে তরুণদের রাস্তা কিংবা তাদের বাসাবাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে অস্বীকারও করছে। অনেক সময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কোনো তথ্যও দিতে চায়না তারা।
ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বেলুচিস্তানে এমন জোরপূর্বক তুলে নিয়ে তরুণদের গায়েব করে ফেলার ঘটনাচিত্র। প্রতিবেদনে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে বালুচ শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
২০০০ সাল থেকেই বেলুচিস্তানে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সেনা সহায়তায় পরিচালিত পাকিস্তানের গোয়েন্দাগুলো কিংবা ফ্রন্টিয়ার্স কর্পস নামের আধাসামরিক বাহিনীর হাতে গত দুই দশকে দশ হাজারের বেশি বেলুচ নাগরিক গুম হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় মূলত তরুণরা লক্ষ্য হলেও নারী, শিশু এমনকি বৃদ্ধদের অপহরণের ঘটনাও আছে।
আবার অপহৃতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কবি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। তবে অপহরণকারীদের মূল্য লক্ষ্যই থাকে তরুণ শিক্ষার্থীরা।
গত দুই দশকে বেলুচ শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করার মতো, এদের মধ্যে অনেককেই হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া অপহরণের শিকার আরো কয়েকহাজার তরুণ এখনও পাকিস্তানের বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে ধুঁকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিখোঁজদের মধ্যে জাকির মজিদ বেলুচ, জাহিদ বেলুচ, সাব্বির বেলুচের মতো কয়েকজন ছাত্রনেতাও রয়েছেন।
শুধু বেলুস্তিানই নয়, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বলপূর্বক গুমের ঘটনা গত কয়েক মাসে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে বিএলএ’র ভয়াবহ হামলার পর থেকেই এ ঘটনা বেড়েছে। যেসব ছাত্র নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের অধিকাংশকেই হয় তাদের বাড়ি থেকে নয়ত ছাত্রাবাস থেকে তুলে নিয়ে বিনা বিচারে আটকে রাখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পাকিস্তানের গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে বেলুচিস্তান এবং দেশটির বিভিন্ন শহর থেকে অন্তত ৪৮ বেলুচ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। তবে অধিকার সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ভয়েস অব বেলুচ মিসিং পারসনসের (ভিবিএমপি) দাবি, নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, নিখোঁজ অনেক তরুণের পরিবারকে মুখ না খোলার ব্যাপারে হুমকিও দেওয়া হয়।
দেশটির গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে ৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৮, মার্চে ৮, এপ্রিলে ৬ এবং মে মাসে ১৯ জন অপহরণের শিকার হন।
যারা পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে হারিয়েছে, এমন পরিবারগুলো মিলে গড়ে তুলেছে ভিবিএমপি।
গুমের ঘটনা বর্তমানে বেলুচিস্তানের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটি দিন নেই যে, সেখানে অপহরণ ঘটনা ঘটে না। বেলুচিস্তানের অধিকাংশ পরিবারেরই কোনো কোনো সদস্য নিখোঁজ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অপহরণ, গুমের প্রতিবাদে বেলুচিস্তানে প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো; হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন।
গুম-অপহরণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভিবিএমপি। সংগঠনটির সবচেয়ে দীর্ঘ সময়- ৪৬৭০ দিন ধরে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালনের ইতিহাসও রয়েছে।
এ বছরের শুরুর দিকে ভিবিএমপি এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানে ‘বলপূর্বক গুমের’ সাথে জড়িত।
সংগঠনটির নেতা মামা কাদির বলেন, কেউ অধিকার আদায়ের কথা বললেই তার মুখ বন্ধর জন্য চাপ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি শাসকরা তাদের বিরুদ্ধ মতকে কঠোরভাবে দমন করছে। এফসি, সিটিডি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বেলুচ নাগরিকদের ‘পদ্ধতিগত অপহরণ’ এবং হত্যা করছে, কারণ তারা (বেলুচরা) অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার সাহস রাখে।
সংগঠনটির চেয়ারম্যান নাসরুল্লাহ বেলুচের ভাষ্য, এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা এবং নিখোঁজদের পরিবারগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
সরকার দাবি না মানলে করাচি, ইসলামাবাদের মতো বেলুচিস্তানেও বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বেলুচিস্তান মানবাধিকার কাউন্সিলের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেলুচিস্তান ছাড়াও পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও সেনা ও তাদের ছত্রছায় পরিচালিত সংস্থাগুলোর অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে তরুণ শিক্ষার্থীরা। ২০২১ সালেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেলুচ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন।
বেলুচিস্তানের স্বীধনতার জন্য আন্দোলন করে আসা বেলুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট (বিএনএম) এ বছরের মে মাসে এক বিবৃতিতে জানায়, তরুণ বেলুচ শিক্ষার্থীদের গুমের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। তাদের অভিযোগ, বেলুচদের মেধাশূন্য করতে পরিকিল্পিতভাবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যেমনটা পাকিস্তান বাহিনী করেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে।
বিএনএম হুঁশিয়ার করেছে, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তারা চুপ করে থাকবে না। বেলুচ জনগণের পক্ষে সোচ্চার হতে তারা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনক চিঠিও দেবে বলে জানিয়েছে।
সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জুনে করাচি প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেলুচ ইয়াকজেহতি (বিওয়াইসি) কমিটি। তারা বেলুচ তরুণদের ওপর নির্যাতন ও কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততার কঠোর নিন্দা জানায়।
সেখানে বিওয়াইসির সংগঠক আমনা বেলুচ এবং অধিকারকর্মী শাম্মি দীন বলেন, পাকিস্তান সরকার প্রতিটি বেলুচ নাগরিককেই সন্ত্রাসী মনে করে। তারা অভিযোগ করেন, বেলুচ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অথচ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।
অপহরণের প্রতিবাদে কোয়েটা, করাচি, ইসলামাবাদসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিওয়াইসি।
তরুণ শিক্ষার্থীরাই কেন লক্ষ্য?
সমাজে ভীতি ছড়াতে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে মানুষকে এভাবে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা পুরনো চর্চা। এর ফলে নিরাপত্তাহীনতার ভয় শুধু ভুক্তভোগীদের স্বজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ছড়িয়ে পড়ে পুরো সমাজে।
দমনমূলক রাষ্ট্রের গোপন এজেন্সিগুলো সম্পূর্ণ ‘দায়মুক্তির’ সুবিধা নিয়ে নিরীহ জনগণের ওপর চড়াও হয়। কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, কোনো বিচার ছাড়াই এই নিপীড়ন চলে।
স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে বেলুচিস্তান। স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র সংগঠন।
সেখানে পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে প্রতিরোধ আন্দোলন। এর মধ্যে অতীতের চেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে জড়িয়েছেন। আন্দোলনে থাকা বেশিরভাগ সশস্ত্র কিংবা নিরস্ত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক অথবা বর্তমান ছাত্রনেতারা।
পাকিস্তান সরকার বিশ্বাস করে, ছাত্র সংগঠনগুলোই সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে সদস্য জোগান দিচ্ছে। তবে তথ্য নেওয়ার জন্য সামান্য সন্দেহ থেকেও ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদ্দশ্য হচ্ছে, অন্য ছাত্রদের ভয় ধরানো যাতে তারা স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত থাকে।
বেলুচ রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, এই জনগোষ্ঠীকে মেধাশূন্য করতেই পাকিস্তানের এই অপচেষ্টা। বেলুচদের অগ্রগতি রুখতে খুব হিসাব কষেই পাকিস্তান সরকার এই কাজে নেমেছে বলেও দাবি তাদের।
বেলুচিস্তানের ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত, কিন্তু তরুণ বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের একের পর এক গুম হয়ে যাওয়া যে বেলুচ সমাজে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কখন কোন তরুণের নাম-ছবি উঠবে নিখোঁজ সংবাদের পোস্টারে, তা নিয়ে প্রতিনিয়তই আতঙ্কে দিন কাটছে সেখানকার পরিবারগুলোর।
এএইচএস
আরও পড়ুন