সেই টার্মিনালেই ত্যাগ করলেন শেষ নিঃশ্বাস
প্রকাশিত : ১২:০৯, ১৩ নভেম্বর ২০২২
চার্লস দ্য গলে মেরহান কারিমি নাসেরির ২০০৪ সালের একটি ছবি
একটানা ১৮ বছর বিমানবন্দরের টার্মিনালে কাটিয়ে দেয়া মেরহান কারিমি নাসেরি তার শেষ নিঃশ্বাসটাও ত্যাগ করলেন সেই টার্মিনালেই। প্যারিস বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা জানান, শনিবার দুপুরের দিকে বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২ এ অবস্থানরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
ইরানি নাগরিক মেরহান কারিমি নাসেরি এক সময় ফ্রান্সে এসে আইনগত ঝামেলার কারণে প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে থাকতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন পরে সেই আইনি ঝামেলা মিটলেও তার আর বাইরে যাওয়া হয়নি। বিমানবন্দরেই তিনি বসবাস করতে থাকেন।
এভাবে জীবনের ১৮টি বছর তিনি পার করে দেন প্যারিসের বিমানবন্দরেই। তার এই ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র পর্যন্ত তৈরি হয়। বিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ মেরহান কারিমির ঘটনা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘দ্য টার্মিনাল’। এছাড়া ফরাসি চলচ্চিত্র ‘লস্ট ইন ট্রানজিট’ ও ‘ফ্লাইট’ নামের অপেরা দুটিও তৈরি হয়েছিল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।
নাসেরি ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্যারিস বিমানবন্দরের টার্মিনাল ১-এ বসবাস করতেন। প্রথম প্রথম বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার মতো কাগজপত্র না থাকায় তিনি বিমানবন্দরেই থাকতে শুরু করেন। কিন্তু এক সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেয়ে গেলেও তিনি বাইরে যেতে আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। ফলে দেড় যুগ ধরে তিনি বিমানবন্দরেই থেকে যান।
বছরের পর বছর তিনি একটি লাল সোফায় থাকতেন ও ঘুমাতেন। বিমানবন্দরের কর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন, কর্মীদের ব্যবহারের ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করতেন। ডায়েরি লিখতেন, ম্যাগাজিন পড়তেন ও ভ্রমণকারীদের জরিপ করতেন। এগুলোই হয়ে ওঠে তার নিত্যদিনের কাজ। বিমানবন্দরের কর্মীরা তাকে ‘লর্ড আলফ্রেড’ নাম দিয়েছিলেন এবং তিনি ধীরে ধীরে যাত্রীদের মধ্যে একজন মিনি-সেলিব্রিটিও হয়ে ওঠেন।
১৯৪৫ সালে ইরানের সোলেমানে জন্ম নেয়া নাসেরি ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে পড়ার জন্য ইরান ত্যাগ করেন। যখন তিনি ফিরে আসেন, রেজা শাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং পাসপোর্ট ছাড়াই বহিষ্কার করা হয়।
তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। এক পর্যায়ে বেলজিয়ামের ইউএনএইচসিআর তাকে শরণার্থী সার্টিফিকেট দেয়, কিন্তু সে সব কাগজপত্র আবার প্যারিসের একটি ট্রেন স্টেশন থেকে চুরি হয়ে যায়। এ অবস্থায় ফ্রেঞ্চ পুলিশ পরে তাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তার কাছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নথি না থাকায় তারা তাকে অন্য কোথাও ফেরত পাঠাতে পারেনি।
এক পর্যায়ে তিনি ১৯৮৮ সালের আগস্টে চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির হন এবং সেখানেই থেকে যান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ক্রমবর্ধমান কঠোর ইউরোপীয় অভিবাসন আইন তাকে বছরের পর বছর ধরে সেখানেই থাকতে বাধ্য করেছিল।
অবশেষে যখন তিনি শরণার্থীর কাগজপত্র পেয়ে যান, তখন নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভোগার কারণে ওই কাগজপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানান। ২০০৬ সালে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত আরও কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করেছিলেন। পরে তিনি প্যারিসের একটি ঠিকানায় থাকতেন। বিমানবন্দরে যারা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল, তারা বলেছিল জানালাবিহীন জায়গায় বসবাসের বছরগুলো তার মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি এক চিকিৎসক তাকে একটা জীবাশ্ম বলেও বর্ণনা করেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে মেহরান নাসেরি আবারও সেই চার্লস দ্য গলে বসবাস করতে শুরু করেন। তবে শনিবার (১২ নভেম্বর) দুপুরের দিকে তিনি সেখানে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বিমানবন্দর পুলিশ ও একটি মেডিকেল টিম তাকে চিকিৎসা দেয়, কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ৭৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, সেই টার্মিনালেই। সূত্র- এপি, সিএনএন।
এনএস//
আরও পড়ুন