জিম্মিদের মৃত্যু ঠেকাতে না পারায় ক্ষমা চাইলেন নেতানিয়াহু
প্রকাশিত : ১৪:০৮, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শনিবার গাজায় থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে না পারায়, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস হুশিয়ারি দিয়েছে, যুদ্ধবিরতি না হলে আরও জিম্মিদের একই পরিণতি বরণ করতে হবে, 'কফিনে ফিরতে হবে পরিবার-পরিজনের কাছে'।
জিম্মিদের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল এখন ইসরায়েল। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা ধর্মঘটে বন্ধ হয়ে গেছে দেশটির কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
এমন পরিস্থিতিতে জিম্মিদের মৃত্যুর ঠেকানোর ব্যর্থতা স্বীকার করে নিজ জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন মি. নেতানিয়াহু।
জিম্মি সংকটকে ঘিরে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও ইসরায়েল সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি উল্লেখ করে ইতোমধ্যেই দেশটির কাছে বেশ কিছু অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
অন্যদিকে, হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যথেষ্ট উদ্যোগ নেননি বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ছয় জিম্মির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন ইসরায়েলের হাজার হাজার মানুষছবির উৎস,EPA
ছবির ক্যাপশান,ছয় জিম্মির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন ইসরায়েলের হাজার হাজার মানুষ
গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য বেশ আগে থেকেই মি. নেতানিয়াহুর ওপর চাপ দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এ লক্ষ্যে সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরায়েল সফরেও গিয়েছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও গাজায় যুদ্ধ থামায়নি ইসরায়েল।
এর মধ্যেই গত শনিবার গাজার রাফাহ এলাকায় হামাসের একটি সুড়ঙ্গ থেকে ছয় জিম্মির মরদেহ খুঁজে পায় ইসরায়েলি সৈন্যরা।
নিহত ছয় জিম্মিদের মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে জানা গেছে। বাকি পাঁচজন ইসরায়েলের নাগরিক।
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের আড়াইশোর বেশি নাগরিককে অপহরণ করে নিয়ে যায় হামাস।
ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করলে অন্য জিম্মিরাও 'কফিনে করে' ফিরবেন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
"চুক্তি স্বাক্ষর না করে শক্তি খাটিয়ে জিম্মিদের মুক্ত করতে নেতানিয়াহুর চাপ দেওয়ার পরিণতি হলো, জিম্মিরা কফিনে করে পরিবারের কাছে ফিরবেন," সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা।
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে
শনিবার ছয় জিম্মির মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেটি এখন দেশটির অন্য শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
পতাকা হাতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন।
জিম্মি ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাদের স্বজনদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরিভিত্তিতে হামাসের সঙ্গে আলোচনা এবং চুক্তি করা দরকার।
এক বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে জিম্মি ব্যক্তিদের পরিবারগুলো বলেছে, নানান অজুহাতে হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে বিলম্ব করার কারণেই নতুন করে আরও ছয় জিম্মির মৃত্যু হয়েছে।
"প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সদিচ্ছা দেখালে আমাদের স্বজনরা এখনো বেঁচে থাকতেন," বলেছে পরিবারগুলো।
মূলত সে কারণেই রাজধানী তেল আভিভের রাস্তায় নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে জিম্মিদের মুক্তির জন্য অবিলম্বে হামাসের সঙ্গে চুক্তির দাবি জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।
তবে হামাসের শর্ত মেনে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে নারাজ দেশটির প্রধানমন্ত্রী মি. নেতানিয়াহু।
উল্লেখ্য যে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করে জিম্মি ইসরায়েলিদের ফিরিয়ে নিতে ফিলাডেলফি সীমান্ত থেকে ইসরাইলি সেনাদের সরিয়ে নিওয়ার শর্ত দিয়েছে হামাস।
মিশর সীমান্ত ঘেঁষা 'ফিলাডেলফি করিডোর' একটি বাফার জোন বা নিরাপদ অঞ্চল, যা প্রায় একশো মিটার প্রশস্ত।
সৈন্য অপসারণ করলে হামাস আবারও গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত ব্যবহার করে অস্ত্র আমদানি শুরু করতে পারে, এমন আশঙ্কা জানিয়ে হামাসের শর্ত মানতে রাজি হচ্ছেনা নেতানিয়াহু প্রশাসন।
এদিকে, জিম্মিদের মুক্তির দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করছে ইসরায়েলের ট্রেড ইউনিয়ন 'হিস্ট্রাড্রট'। সোমবার ওই ধর্মঘটের ডাক দেন তারা।
আবার, তেল আবিবে মিছিল করতে গিয়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়ছেন বিক্ষোভকারীরা। তাদের অনেকেই শারীরিক নির্যাতন ও আটকের শিকার হয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
যদিও দেশটির পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তারা বাধ্য হয়েছেন।
'নেতানিয়াহু যথেষ্ট উদ্যোগ নেননি'
হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যথেষ্ট উদ্যোগ নেননি বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
জিম্মি মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর খবরে শোক প্রকাশ করেছেন তিনি।
"সাতই অক্টোবর ইসরায়েলে শান্তির জন্য যে কনসার্ট আয়োজন হয়েছিল, সেখানে হামলা চালিয়ে যেসব নিরপরাধ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছিল, হার্শ (নিহত মার্কিন নাগরিক) তাদেরই একজন," এক বিবৃতিতে বলেন মি. বাইডেন।
উল্লেখ্য যে, সাতই অক্টোবর সংঘটিত হামাসের নজিরবিহীন হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়। সেইসঙ্গে, আরও অন্তত ২৫২ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
অভিযান শুরুর পর গত নভেম্বরে বন্দি বিনিময়ের শর্তে গাজায় সাতদিনের একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল ইসরায়েল।
সেসময় সময় শতাধিক জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। একইভাবে, ইসরায়েলও তাদের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের কয়েকজনকে মুক্তি দেয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, গাজায় হামাসের কাছে এখনও অন্তত ৯৭ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছেন।
এছাড়া জিম্মি অবস্থায় মারা গেছেন কমপক্ষে ৩৩ জন।
যুদ্ধের আড়ালে ভূমি দখল
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে একটা হলো ফিলিস্তিনের বাত্তির। সেখানকার জলপাই বাগান এবং আঙুরক্ষেতের জন্য পরিচিত এই গ্রাম।
এখানে প্রাকৃতিক ঝর্ণার জল ব্যবহার করা হয় সেচের কাজে। কয়েক শতাব্দী ধরে এইভাবেই জীবন বয়ে চলেছে সেখানে।
প্রকৃতির কোলঘেঁষা এই গ্রামই অধিকৃত ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’ বা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের সর্বশেষ ‘ফ্ল্যাশপয়েন্টে’ পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েল এখানে একটা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন বা ‘সেটলমেন্ট’-এর অনুমোদন দিয়েছে।
এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরায়েলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে।
যাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি এই নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের তালিকায় রয়েছে ঘাসান ওলিয়ান। তিনি বলেন, “নিজেদের স্বপ্ন গড়তে আমাদের জমি চুরি করছে ওরা।”
ইউনেসকো জানিয়েছে বাত্তিরকে ঘিরে বসতি স্থাপনকারীদের পরিকল্পনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তবে এই গ্রাম কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ জাতীয় স্থাপনাকে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এ বিষয়ে ইসরায়েল ভিন্নমত পোষণ করে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান রোনেন বার মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে তাদের সতর্ক করেছিলেন।
সেই চিঠিতে মি. বার উল্লেখ করেছিলেন পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ কাজ চালাচ্ছে এবং দেশের ‘অবর্ণনীয় ক্ষতি’ করছে।
এদিকে, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই অধিকৃত পশ্চিম তীরে দ্রুত বসতি স্থাপন হচ্ছে।
ইসরায়েল সরকারের থাকা চরমপন্থীরা অবশ্য ‘গর্ব’ করে বলেন এ পরিবর্তন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেবে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিজেদের ‘লক্ষ্য’ পূরণের জন্য গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছে এই চরমপন্থীরা।
বসতি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণকারী ইসরায়েলি সংস্থা ‘পিস নাও’-এর ইয়োনাতান মিজরাহি বলেছেন, “ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের চরমপন্থী ইহুদিরা ইতিমধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও কঠিন করেছে।”
তার মতে সাতই অক্টোবরের হামলা পর ইসরায়েলি সমাজে ‘ক্রোধ ও ভয়ের মিশ্রণ’ রয়েছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জুন মাসের একটা সমীক্ষা বলছে, ৪০ শতাংশ ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন যে এই বসতি স্থাপন তাদের দেশকে নিরাপদ করেছে।
এর আগে ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, জুন মাসের ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৩৫ শতাংশ মানুষ আবার মনে করেন, বসতি স্থাপনের কারণে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের জরিপে ওই পরিসংখ্যান ছিল ৪২ শতাংশ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/
আরও পড়ুন