ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এক বছরে আরও বিস্তৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে
প্রকাশিত : ১২:২৯, ৭ অক্টোবর ২০২৪ | আপডেট: ১২:৩৫, ৭ অক্টোবর ২০২৪
ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজা যুদ্ধ শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। বছর শেষে সেই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে আর যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হয়েছে।
ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ ছিলো ইসরায়েলিদের জন্য ভয়াবহ একটি দিন। প্রায় বারশ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, নিহত হয়েছিলো।
ঘটনার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ফোন করে বলেছিলেন যে, “আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে কখনো এ ধরনের বর্বরতা দেখিনি”।
ইসরায়েলিরা হামাসের ওই হামলাকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিলো।
এরপর ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালায় যাতে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে তাদেরও বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিক।
গাজার বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ফিলিস্তিন গণহত্যার অভিযোগ এনেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।
যুদ্ধ এরপর আরও ছড়িয়েছে। হামাসের হামলার ১২ মাস পর এসে মধ্যপ্রাচ্য এখন ভয়াবহ ও আরও ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে।
গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ
গত বছর ডিসেম্বরে গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। গাজায় হামাসের ব্যবহৃত ৮০০টির মত "সন্ত্রাসী টানেল" পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিলো ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ।
এর মধ্যে ৫০০টি ধ্বংস করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
আর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন "সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে" প্রায় দশ হাজারের মত বিমান হামলা চালানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে আইডিএফ।
এই যুদ্ধ গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইসরায়েলকে।
হামাস ও হেজবুল্লাহ নেতা নিহত
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে ইসরায়েলি হামলায় 'নিহত' হওয়ার কথা সংগঠনটি জানায় ৩১শে জুলাই। ইরানের রাজধানী তেহরানে তার বাসস্থানে "জায়নবাদী গুপ্ত হামলায়" এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তারা।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়।
ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়ে, যার ডাক নাম আবু আল-আবদ, জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
অন্যদিকে শেখ হাসান নাসরাল্লাহ হলেন একজন শিয়া ধর্মপ্রচারক, যিনি ১৯৯২ সাল থেকে লেবাননের ইরানপন্থী শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
২৮শে অক্টোবর ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স দাবি করেছে যে বৈরুতে এক হামলায় হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে।
এর আগে পহেলা অক্টোবর থেকে ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে স্থল অভিযান শুরু করেছে বলে জানায় তাদের ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফ।
যেসব জায়গায় হামলা হচ্ছে সেগুলো ইসরায়েলি কমিউনিটির জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করে তারা।
বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।
ইসরায়েলে ইরানের সরাসরি হামলা
গত এপ্রিলে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলায় কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারের মৃত্যুর ঘটনায় ইসরায়েলে ৩০০টির বেশি ড্রোন হামলা চালিয়েছিল ইরান। ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে এটিই ছিলো ইরানের প্রথম সরাসরি হামলা।
সেসময় প্রায় সবগুলো ড্রোনই ভূপাতিত করেছিল ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের আরব মিত্ররা। ঐ হামলায় ইসরায়েলের একটি বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জবাবে তখন ইরানের একটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
এরপর চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আবারো শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। মূলত হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার জেরে এই হামলা করে ইরান।
হামলার পর ইসরায়েলজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফারণের শব্দ শোনা গেছে এবং ইরানের মিসাইল নিক্ষেপের কথা জানিয়ে একটি বিবৃতিও দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
তারা বলেছে, প্রায় ১৮০টি মিসাইল ছোড়া হয়েছে এবং অনেক মিসাইল ভূপাতিত করা হয়েছে, তবে মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলে 'কিছু আঘাতের' ঘটনাও ঘটেছে।
ইরানকে এই হামলার 'পরিণাম ভোগ করতে হবে' বলেও হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল।
লেবাননে ব্যাপক হামলা
হেজবুল্লাহ স্থাপনা লক্ষ্য করে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
পহেলা অক্টোবর হামলা শুরুর আগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বৈরুতে শহরের তিনটি এলাকা থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বলেছেন এই হামলার কারণে অন্তত দশ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে।
হেজবুল্লাহর ডেপুটি কমান্ডার নাইম কাসেম বলেছেন ইসরায়েলের স্থল অভিযানের জন্য তারা প্রস্তুত এবং এই যুদ্ধ ‘দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে’।
নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়েছে গত জুনে।
প্রস্তাবে শর্ত হিসেবে রাখা হয়েছে "পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি", হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি, মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ ফেরত দেয়া এবং ফিলিস্তিনি বন্দী বিনিময়।
ইসরায়েল ইতোমধ্যে প্রস্তাবে সম্মত আছে বলে রেজল্যুশনে উল্লেখ করা হয়। হামাসকেও রাজি হতে তাগিদ দেয়া হয়েছে এতে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলো ইউরোপের তিন দেশ
চলতি বছর মে মাসে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের তিন দেশ- স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে। দেশগুলো বলেছে, তাদের এই স্বীকৃতি দেয়ার মানে হলো মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করা।
স্বীকৃতি দেয়া তিনটি দেশ তখন বলেছিলো যে তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে যখন জেরুসালেমকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন- উভয় দেশের রাজধানী হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য পদ দেয়ার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব এই বছরের মে মাসে পাস হয়েছে সাধারণ পরিষদে। তবে এই বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে এখনো ভোটাভুটি হয়নি।
ফিলিস্তিনের পক্ষে আমেরিকায় বিক্ষোভ
চলতি বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে।
বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয়েছিল কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। পরে তা পঁচিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আটলান্টায় বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হয় এ ঘটনায়।
টেক্সাসের অস্টিনে সেখানকার গভর্নর ট্রুপারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের আটক করতে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/
আরও পড়ুন