রোহিঙ্গা নিধনের ৬ মাস
সংকট-উৎকণ্ঠার আবর্তে রোহিঙ্গারা
প্রকাশিত : ১০:১৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১২:০৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
দিন যতই যাচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনও ততটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠছে। বিশেষ করে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠানো আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় তাঁদের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এদিকে কুতুপালং ক্যাম্পসহ প্রতিটি ক্যাম্পেই নারী ও শিশুরা ভোগছে পাচার ও যৌন নির্যাতনের শঙ্কায়। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বর্ষা মৌসুমের পাহাড়ি ঢল। অন্যদিকে এখনো থামছে না রোহিঙ্গার আগমন। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোয় রোহিঙ্গাদের জন্য ভয়াবহ-দুর্বিষহ জীবন অপেক্ষা করছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির তিনমাস পার হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও দেশটিতে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো রোজ অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এদিকে চুক্তির আওতায় রোজ ৩০০ জন করে রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার কথা রয়েছে মিয়ানমারের। এরই অংশ হিসেবে ৮ হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা মিয়ানমারের হাতে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
তবে মিয়ানমার জানিয়েছে, ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করতে একটু সময় লাগবে। এরপরই তাঁরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করবে।
এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নানা সংকটে ভোগছে বলে জানায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তাঁদের দাবি, রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠানো আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার পরিমাণ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা ভোগছেন ত্রাণ সংকটে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের দেওয়া দেশীয় ত্রাণ সহায়তা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয়মাস পূর্তি উপলক্ষে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে দাতা সংস্থা আইএসসিজি জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ইতোমধ্যে ভয় আর আতঙ্গ দেখা দিয়েছে। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। এ ছাড়া নারী ও শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে আগের তুলনায় কয়েকগুন। পাচারকারী চক্র সক্রিয় থাকায় শিশুরা আছেন ভয়াল সংকটে।
আইএসজির জ্যৈষ্ঠ সমন্বয়ক সামভাল রিজভী বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অনেক নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এখনো বনে-জঙ্গলে কাঠ কুঁড়োতে গেলে তারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া পাচারকারী চক্রের সদস্যরা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে কাজ দেওয়ার আশায় ক্যাম্প থেকে বের করে আনছে। পরে সুযোগ বুঝে বিভিন্ন জায়গায় পাচার করে দিচ্ছে।
এদিকে সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ওয়ার্ল্ড মিশন নামের তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ গবেষণা-‘আতঙ্কিত শৈশব: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের কথা’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও শিশুদের যৌন নির্যাতনসহ নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে। রাজধানীর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ওই সংস্থাগুলো। কক্সবাজারের ২০০ রোহিঙ্গা শিশু ও তাঁদের ৪০ জন মায়ের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন করেছে তারা।
সেভ চ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডেভেলাপমেন্ট এন্ড কোয়ালিটি বিভাগের প্রধান রিফাত বিন সুলতান বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময়ও রোহিঙ্গারা দেশটিতে সেনাদের দ্বারা হত্যা, ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে এসেও তারা পুরোপুরি নিরাপদ থাকছেন না। এখনো তারা নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শৌচাগার সংকটের কথা তুলে ধরে বিন সুলতান বলেন, সেখানে নারী, পুরুষ-শিশুদের লাইন ধরতে হয়। সেখানেও নারী ও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এমন রোহিঙ্গা পুরুষদের দ্বারাও তারা আক্রান্ত।’
রিফাত বিন সুলতান আরও বলেন, বন্য জীবজন্তুসহ আরও নানা প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। বন্য সাপ, হাতিসহ আরও নানা প্রাণীর আক্রমণের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে আসছে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের কারণে তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ দুর্বিষহ ঘটনা।
এদিকে শরণার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ৬ লাখ ৮৮ হাজার। পাসপোর্ট অধিদপ্তর এ পর্যন্ত অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গার বায়োমেট্টিক নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। সাড়ে তিন হাজার একর ভূমিতে তাঁদের জায়গা দেওয়া হয়েছে। এদিকে অধিক মানুষ একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার ফলে সেখানে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান বন্ধ করতে ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেশটিতে ফেরত নিতে জাতিসংঘ বারবার আহ্বান জানালেও দেশটি রোহিঙ্গা নিধন অভিযান বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আবারও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে ওঠছে রোহিঙ্গা ইস্যু। জানা গেছে, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আজ সোমবার পরিষদের ৩৭তম অধিবেশনের প্রথম দিনেই জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়ীদ রা’দ আল হুসাইন রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি উপস্থাপন করবেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করা জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরাও এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আগামী ১২ মার্চ অধিবেশনে মিয়ানমারে জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন’ পাঠানো নিয়ে আলোচনা হবে এবং মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের ‘স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার’ (বিশেষ দূত) ইয়াংহি লি বক্তব্য দেবেন।
প্রসঙ্গত মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ নিরীহ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের দাবির প্রেক্ষিতে দু’দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এমজে/ এআর
আরও পড়ুন