বিবিসির বিশ্লেষণ
ভারতে আইনের ফাঁক গলে ছাড়া পাচ্ছেন হিন্দুত্ববাদীরা
প্রকাশিত : ১১:০৩, ২২ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১২:০৮, ২২ এপ্রিল ২০১৮
ভারতের গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার একটি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ও প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানীকে খালাস করে দিয়েছেন আদালত। আহমেদাবাদের নারোদা পাটিয়া এলাকার ওই দাঙ্গায় ৯৭ জন মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিলেন।
আদালত বলছেন, বিজেপি নেত্রী মায়াকোদনানীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে আদালত বাবু বজরঙ্গী নামে আরেক হিন্দুত্ববাদী নেতার আজীবন কারাবাসের শাস্তি কমিয়ে ২১ বছর জেল দিয়েছে।
শুধু এই মামলা নয়, সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন আদালতে এমন কিছু রায় হয়েছে, যেখান থেকে অভিযোগ-মুক্ত হয়েছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা।
গত বৃহস্পতিবারই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে এক বিচারপতির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে নতুন করে তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। এক মুসলমান যুবককে ‘ভুয়া সংঘর্ষে হত্যার’ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ। তিনিও খালাস পেয়েছেন।
এর আগে, হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদে একটি বিস্ফোরণের মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতারা।
পর পর এই কয়েকটি রায়ের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কীভাবে হিন্দুত্ববাদী নেতারা একের পর এক সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা থেকে অভিযোগ মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন? এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন আইনজীবী মহলও।
সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলছিলেন, এইসব মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরা বলছেন যে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। এই অভিযুক্তরা নির্দিষ্ট অপরাধগুলোতে জড়িত না থাকতে পারেন, কিন্তু তারা বলছেন না যে অন্য যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বার কর, নতুন করে তদন্ত কর। বিচারপতিরা তো ঘটনার বাস্তবতাকেই অস্বীকার করে ফেলছেন।
বিকাশ রঞ্জন বলছেন, যে ঘটনা গুজরাটে হয়েছে, বা মক্কা মসজিদে ঘটেছে, বা বিচারক লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যু- সব ক্ষেত্রেই ঘটনার প্রেক্ষিতটাকে বিচারপতিরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তদন্ত করে দেখা উচিত যে বিচারপতিদের ওপরে হিন্দুত্ববাদের কোনও প্রভাব পড়ছে কী না।
গুজরাট দাঙ্গার ঘটনাটিতে দেখা গেছে ১১ জন সাক্ষী তাদের আগে দেওয়া বয়ান বদলে ফেলেছেন। তাই তাদের বয়ান বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রথমে বহু সংখ্যক মুসলমান যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা পরে মুক্তি পায়, আর অভিযোগ ওঠে একটি কট্টর হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে। তাদের গ্রেফতার করেছিল জাতীয় সন্ত্রাস দমন এজেন্সি বা এনআইএ।
যে বিশেষ আদালতে ওই মামলার রায় দেওয়া হয়, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পদত্যাগ করেন সেই বিচারক। যদিও বৃহস্পতিবার তিনি আবার কাজে ফিরেছেন।
ওই মামলায় যিনি এন আই এর হয়ে সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন, তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন যে আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা।
আবার মহারাষ্ট্রের যে আদালতে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ-র বিরুদ্ধে মামলা চলছিল, সেই বিচারকের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে তারই কয়েকজন সহকর্মীর বয়ানকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
পরে অবশ্য অমিত শাহকে ওই মামলায় অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত। কিন্তু গতবছর একটি সংবাদমাধ্যমের তদন্তমূলক প্রতিবেদনের ফলে ধোঁয়াশা তৈরি হয় ওই বিচারকের মৃত্যুর ঘটনাক্রম ও কারণ নিয়ে।
পর পর একই ধরণের রায়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নেতা-নেত্রীরা মুক্তি পাওয়ায় কলকাতা হাইকোর্টেরই সিনিয়র আইনজীবী সর্দার আমজাদ আলি বলছিলেন, এই রায়গুলোর পর দেশের মানুষের মনে একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ভারতের বিচার ব্যবস্থার গৈরিকীকরণ হয়েছে কী-না!
আমজাদ আলি বলেন, ‘দ্বিতীয় বিষয় হল, যদি এই ধরনের মামলাগুলোতে প্রমাণের অভাবেই অভিযুক্তদের ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেটা কি তাদের দক্ষতার অভাব না অন্য কোনও রহস্য আছে সেই প্রশ্নও উঠছে।
বোম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখার্জী অবশ্য মনে করেন না যে বিচার ব্যবস্থার ওপরে কেউ কোনও প্রভাব খাটাচ্ছে। তিনি বরং বলছেন, কোনও অপরাধী যদি ছাড়া পেয়ে যায়, সেই ব্যর্থতার দায় তদন্তকারী এজেন্সিগুলির।
তিনি বলেন, এই সব মামলার রায়গুলো কাকতালীয় হতে পারে। রাজনৈতিক কারণে রায় প্রভাবিত হয়েছে, এটা বলা শক্ত। এমনটাও তো হতে পারে যে মামলাগুলো শুরুই হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে! তদন্তকারীরাও ঠিক মতো কাজ করেছেন কী-না, দেখার বিষয় সেটাও। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় তো নেই।
ঘটনাচক্রে, গত শুক্রবার ভারতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব এনেছেন ৬৪ জন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য।
প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তিনি বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি অসদাচরণেরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
দীপক মিশ্র যে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মামলাগুলি বিচারের ভার সিনিয়র বিচারপতিদের কাছে না পাঠিয়ে জুনিয়রদের বেঞ্চে পাঠাচ্ছেন, তা নিয়ে আগেই অভূতপূর্বভাবে সংবাদ সম্মেলন করে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ভারতের চারজন প্রবীনতম বিচারপতি।
ওই চার বিচারপতি যে মামলাগুলির প্রসঙ্গে মুখ খুলেছিলেন প্রধান বিচারপতির কাজকর্মের বিরুদ্ধে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিচারক লোয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত মামলাটি - যে মামলায় একসময়ে অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ।
গুজরাট দাঙ্গা বা মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের রায়গুলির পরে ওই ঘটনাগুলিতে স্বজন হারানো অনেক মানুষই বিবিসির সংবাদদাতাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে তারা যা স্বচক্ষে দেখেছিলেন, তা কি ভুল? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যদি কোনও প্রমাণই না পাওয়া যাবে, কেউ যদি অপরাধী না-ই হবে, তাহলে ওই দাঙ্গা বা বিস্ফোরণগুলো ঘটালো কারা!
সূত্র:বিবিসি
একে//
আরও পড়ুন