রাজনীতিতে মাহাথিরের ৭২ বছরের পথচলা
প্রকাশিত : ১৭:৩৮, ১০ মে ২০১৮
মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছেন ৯২ বছর বয়স্ক ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। এবার তিনি যে মালয়েশিয়ার ক্ষমতা নিচ্ছেন ৩৭ বছর আগে প্রথমবার তিনি যখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন-তখন আর এখন যেন আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
মাহাথিরে রাজনীতিতে অভিষেক ১৯৪৬ সালে। সেই থেকে আজকের ২০১৮ সালে তার রাজনীতির বয়স ৯২। এর মধ্যে সরকার প্রধান ছিলেন ২২ বছর।
যে গল্পের হিরো ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, সেই গল্পের শুরুটা কিন্তু অন্য আট-দশটি দুনিয়া পাল্টানো গল্পের মতোই সাদামাটা। বদলে ফেলার জন্য চাই জীর্ণশীর্ণ একটা অবয়ব। সেই অবয়বকে আমূল পাল্টে ফেলাটাই একজন শিল্পী কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টার কাজ। মাহাথির সেই স্বপ্নদ্রষ্টা। আর মাহাথিরের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু আজকের আধুনিক মালয়েশিয়া। কিন্তু আলো ঝলমলে যে আধুনিক মালয়েশিয়া আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, সেই চোখ ধাঁধানো কী আগে থেকেই ছিল? ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। এই মালয়েশিয়া আসলে রূপকথার সফল বাস্তবায়নেরই প্রতিচ্ছবি।
মাহাথির মোহাম্মদ ২২ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মালয়েশিয়াকে এক শতাব্দী এগিয়ে দিয়েছিলেন। টানা দুই দশকেরও বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় তাঁর কিছু সমালোচনা থাকলেও মালয়েশিয়ানদের স্বার্থের বাইরে কিছুই করেন নি পেশাদার চিকিৎসক থেকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়া মাহাথির। মালয়েশিয়ায় কাঠামোগত ও গুণগত পরিবর্তন আনেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধন করেন। গোটা মালয়েশিয়াকে স্তরে স্তরে সাজান। বাণিজ্যিক, প্রশাসনিকসহ কয়েক ভাগে ভাগ করে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলেন। স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। নাগরিক সেবা জনগণের দোঁড়গোয়ায় পৌছে দেন। তার সুদূরপ্রসারী চিন্তার এক সময়কার ঔপনিবেশ মালয়েশিয়া আজ শুধু পৃথিবীর অন্যতম আকাঙিক্ষত বাসযোগ্য নগরীই নয়, এশিয়ার টাইগারও।
ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন মাহাথির। এরপর জন্মভূমি কেদাহ রাজ্যে সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল মালয়েশিয়া। ওই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি। ওই দলের মূল আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। এটি এখনো মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। সেই থেকে ৭২ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার মাহাথিরের।
মাহাথির ধীরে ধীরে ‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইউএমএনও দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে ১৯৬৯ সালে ঘটে ছন্দপতন। তৎকালীন সরকার প্রধান টেংকু আব্দুল রহমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পার্লামেন্ট আসন হারান তিনি। মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়েন তিনি।
রাজনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার পর বই লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। নিজের আদর্শ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে একটি বিতর্কিত বই লেখেন তিনি। বইটির নাম ছিল ‘দ্য মালয় ডিলেমা’। ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই মালয় সম্প্রদায়কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছিল। আর এই বিষয়টি মেনে নিতে মালয় সম্প্রদায়কে বাধ্য করা হয়েছিল।
দ্য মালয় ডিলেমা প্রকাশিত হওয়ার পর রাজনীতিবিদ হিসেবে ডক্টর এমের পুনরুত্থান ঘটে। পশ্চিমা নব্য ঔপনিবেশিকদের প্রতি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে-তা ঠিক করতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইউএমএনও দলের তরুণ নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাহাথির। দলে ফিরেই ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। এরপর মন্ত্রিসভায় ঢুকে যান মাহাথির। পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। টেংকু আবদুল রহমান ক্ষমতা ছাড়লে মাহাথিরের প্রমোশন হয়। তিনি দেশের উপ প্রধানমন্ত্রী হন।
মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার চার বছরের মধ্যে নিজ গুণে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মাহাথির মোহাম্মদ। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মাহাথির।
মালয়েশিয়াকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়
ক্ষমতাকালীন ২২ বছরে মাহাথির মালয়েশিয়াকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি তার অন্যতম অবদান। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে তিনি শিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত করেন। বিমান, টেলিযোগাযোগ খাতসহ অন্যান্য সরকারি খাতকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেন, ফলে কর্মজীবীদের কর্মসংস্থানের অবস্থা অনেক উন্নত হয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ‘ডক্টর এম’ দেশ নিয়ে তাঁর চিন্তাগুলোর বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, স্টিল ও গাড়ির উৎপাদক দেশে পরিণত করেন। অথচ এর আগে মালয়েশিয়া শুধু রাবার ও টিন রপ্তানি করত। টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন তিনি। ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়েন মাহাথির। ক্ষমতায় থাকাকালীন মালয়েশিয়াকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করার জন্য তিনি ২০২০ নাগাদ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেন যার পুরোটা বাস্তবায়ন না হলেও মালয়েশিয়াকে এগিয়ে নিতে বড় ভুমিকা রেখেছে।
মাহাথিরকে নিয়ে সমালোচনা
দেশকে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে এলেও, মাহাথিরের সমালোচনাও কম হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অনেক মানুষই তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেন না। মালয় সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের সূচনাও করেছিলেন মাহাথির।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাঁর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো সব ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন মাহাথির। আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। অথচ ১৯৯৮ সালে সেই আনোয়ারকেই বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। সেই অভিযোগে সাজা পেয়েই এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি আনোয়ার।
তবে শুধু আনোয়ার নন, ক্ষমতা ছাড়ার পর সব উত্তরসূরির সমালোচনাতেই মুখর ছিলেন ডক্টর এম। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মাহাথিরই প্রথম নাজিবকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নাজিব প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তাঁর সমর্থন নিয়ে। এবার শিষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাহাথির বলছেন, আগে তিনি ভুল করেছিলেন! এবার সেগুলো শুধরে নিতেই ক্ষমতায় আসতে চান তিনি।
/ এআর /
আরও পড়ুন