যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবির প্রভাব
আল-জাজিরার সাড়া ফেলে দেওয়া সেই প্রতিবেদন প্রচার বন্ধ
প্রকাশিত : ১১:০০, ১৪ মে ২০১৮ | আপডেট: ১১:০১, ১৪ মে ২০১৮
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি লবি কতটা প্রভাব বিস্তার করে? এই বিষয়ে উপর ব্রিটের পর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে আল-জাজিরা। এবার ইসরায়েলি লবির প্রভাব নিয়ে করা ডকুমেন্টারি খোদ আল-জাজিরায় প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে এর পেছনে কারা আছে?
সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক আল জাজিরার একটি অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি ছবির প্রদর্শন `স্থগিত` হয়ে যাওয়ায় এই প্রশ্নটি আবার আলোচিত হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমে। আল জাজিরা টেলিভিশন সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা দেশগুলিতে ইসরায়েলি লবির প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছে। গত বছর ব্রিটেনের রাজনীতিতে ইসরায়েলি লবির প্রভাব নিয়ে তাদের চার পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। সেটি মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র পুরস্কার (সিনে গোল্ডেন ঈগল এওয়ার্ড) জিতেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় আল জাজিরার পরবর্তী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবির প্রভাব নিয়ে। ছবিটির নাম `দ্য ইসরায়েলি লবি`। এটির নির্মাতা আল জাজিরার অনুসন্ধানী রিপোর্ট বিভাগের সাংবাদিক ক্লেটন সুইশার। ছবিটি আল জাজিরায় প্রচার হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল গত কয়েক মাস ধরেই। কিন্তু এখনো এটি প্রচার করা হয়নি। কবে হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না।
কিন্তু এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ইসরায়েলিপন্থী ইহুদী গোষ্ঠীগুলোর চাপেই `দ্য ইসরায়েলি লবি`র প্রচার বন্ধ হয়ে গেল কীনা। ইসরায়েলি লবি নিয়ে আল জাজিরার ডকুমেন্টারি কি আদৌ দেখানো হবে?
ব্রিটেনে ইসরায়েলি লবির প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং কিভাবে তারা ব্রিটেনের ভেতরের রাজনীতিতে নাক গলায় তা নিয়ে চার পর্বের দ্য লবি প্রচারিত হয় গত বছরের জানুয়ারিতে।
প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি রীতিমত শোরগোল তৈরি করে ব্রিটিশ রাজনীতিতে। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় কিভাবে গোপনে তৎপরতা চলে, সেটিই মূলত প্রকাশ করা হয় এতে। একজন আন্ডারকভার রিপোর্টার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে একটি ঘটনা ফাঁস করে দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
স্যার অ্যালান ডানকান হচ্ছেন ব্রিটেনের `ফরেন অফিস মিনিস্টার`। পররাষ্ট্র দফতরে বরিস জনসনের পর তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের বিরুদ্ধে খুবই সমালোচনামুখর ছিলেন তিনি। তাঁর ভূমিকায় ইসরায়েল স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ।
আল জাজিরার ডকুমেন্টারিতে দেখা যায়, লন্ডনে ইসরায়েলি দূতাবাসের এক কর্মকর্তা এবং ব্রিটিশ এক সরকারি কর্মকর্তা গোপনে বৈঠক করে ষড়যন্ত্র করছিলেন কিভাবে ঐ মন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া যায়। গোপনে রেকর্ড করা তাদের দু`জনের কথোপকথন দেখানো হয় এই ডকুমেন্টারিতে। এতে ইসরায়েলি দূতাবাসের পলিটিক্যাল অফিসার শাই মেসট`কে বড়াই করে বলতে শোনা যায়, স্যার আলান ডানকানকে দরকার হলে সরিয়ে দেয়া হবে।
এই ডকুমেন্টারিটি প্রচারের পর ইসরায়েলকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। ব্রিটেনের মতো একটি ক্ষমতাধর দেশের পররাষ্ট্র দফতরে কে থাকবেন আর থাকবেন না, সেটিও ইসরায়েল ঠিক করে কীনা সে প্রশ্ন উঠে। ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত মার্ক রেগেভ এ নিয়ে ক্ষমা চান। পলিটিক্যাল অফিসার শাই মেসটকে পদত্যাগ করতে হয়। আর ব্রিটেনের পররাষ্ট্র নীতিতে বিদেশিরা নাক গলাচ্ছে কিনা তা নিয়ে একটি পার্লামেন্টারি তদন্ত শুরু হয়।
কিন্তু ব্রিটেনের ইসরায়েলপন্থী ইহুদী গোষ্ঠী এবং সংগঠনগুলো এই বলে শোরগোল করতে থাকে যে এই অনুষ্ঠানটি ছিল ইহুদী-বিদ্বেষী। ব্রিটেনের মিডিয়া রেগুলেটর `অফকমে` বহু অভিযোগ জমা পড়ে আল জাজিরার বিরুদ্ধে। করে। কিন্তু অফকম প্রতিটি অভিযোগ নাকচ করে দেয়।
কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে সিনে গোল্ডেন ঈগল এওয়ার্ড জিতেছে এই ডকুমেন্টারি। এটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ একটি পুরস্কার। এর আগে যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ, স্পাইক লী, মাইকেল মুর এর মতো চিত্র নির্মাতা। কিন্তু আল জাজিরা ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদী এবং ইসরায়েলি লবির প্রভাব নিয়ে যে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে, সেটি কেন প্রচারিত হচ্ছে না, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
দ্য ইসরায়েলি লবি: কী আছে যুক্তরাষ্ট্রের পর্বে
দ্য লবির দ্বিতীয় পর্বটি যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবির কাজকর্ম নিয়ে। এটি অনেকটা ব্রিটেনে ইসরায়েলি লবির ডকুমেন্টারির অনুরূপ। ২০১৬ সালে একজন আন্ডারকভার বা ছদ্মবেশি রিপোর্টার একটি ইসরায়েলিপন্থী সংগঠনের কাজকর্ম ভিডিও করেন। সেখানে তাদের তৎপরতা ফাঁস করা হয়। এই ডকুমেন্টারিতে ইসরায়েলি এবং ইহুদী লবি`র যাদের ব্যাপারে কথা-বার্তা আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল আল জাজিরা। সেজন্যে তাদের চিঠিও দেয়া হয়। তখনই এই গোপন অনুসন্ধানের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।
যাদের সঙ্গে আল জাজিরা যোগাযোগ করেছিল, তারা এই সিরিজটি সম্প্রচার না করার কথা বলে। এটি এখনো পর্যন্ত প্রচার করা হয়নি। এমন জল্পনা রয়েছে যে, ইসরায়েলপন্থী লবিগুলোর চাপে হয়তো আল জাজিরা এটির প্রচার বন্ধ রেখেছে। একটি ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎয দাবি করছে যে, মূলত কাতারের শাসকদের চাপেই আল জাজিরা এই ডকুমেন্টারিটির প্রচার স্থগিত রেখেছে।
হারেৎয এর খবর অনুযায়ী আমেরিকার প্রভাবশালী ইহুদী নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল কিছুদিন আগে কাতার ভ্রমণ করেন। সেসময় তারা কাতারের আমীরের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে একজন এই ডকুমেন্টারি প্রচার না করার জন্য আমীরকে অনুরোধ জানান।
উল্লেখ্য আল জাজিরা টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক হচ্ছে কাতার সরকার। কিন্তু কাতার সরকার কেন ইসরায়েলপন্থী এবং ইহুদী গোষ্ঠীগুলোর কথা আমলে নিচ্ছে?
হারেৎযের রিপোর্টে এর ব্যাখ্যা রয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর আরোপ করা অবরোধের মুখে কাতার মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও ভালো করার। সেই লক্ষ্যে কাতার যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রভাবশালী লবিস্ট নিয়োগ করে। সেই লবিস্টকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রভাবশালী ইহুদী সংগঠনগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলার। যাতে তাদেরকে কাজে লাগানো যায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে।
কাতারের প্রতিশ্রুতি
হারেৎয পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কাতারের শাসকরা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদী-আমেরিকান সংগঠনগুলোকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে এই ডকুমেন্টারিটি প্রচার করা হবে না। ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় গত ১৫ই মার্চ প্রকাশিত একটি খবরে অনেকটা একইরকম ভাষ্য রয়েছে এ বিষয়ে।
কিন্তু ছবিটির যিনি নির্মাতা, সেই ক্লেটন সুইশার কি বলছেন এ বিষয়ে?
যুক্তরাষ্ট্রে প্রগতিশীল ইহুদীদের একটি প্রভাবশালী `ফরোয়ার্ড` ম্যাগাজিনে ক্লেটন সুইশার এ বিষয়ে নিজেই একটি লেখা লিখেছেন। সেখানে তিনি স্বীকার করছেন যে, তাদের ছবিটির প্রচার বন্ধ করার জন্য কেউ হয়তো জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলছেন, গত অক্টোবর থেকে এই ছবির কাজ নিয়ে নানা ধরণের বিলম্বের মুখে পড়ছেন তারা, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। যেরকম অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি। তাকে সবাই `অপেক্ষা` করতে বলছেন বারবার। তাকে বারবার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে তাদের ডকুমেন্টারি শেষ পর্যন্ত দিনের আলো দেখবে। তিনি বলছেন, তিনি এখনো তার উর্ধ্বতনদের কথায় আশ্বাস রাখতে চান।
ক্লেটন সুইশারের মতে, তাদের তৈরি এই ডকুমেন্টারি আল জাজিরা নেটওয়ার্কের স্বাধীতনতার জন্য এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কী বলছে আল জাজিরা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদী সংগঠন `জিওনিষ্ট অর্গেনাইজেশন অব আমেরিকা`র প্রেসিডেন্ট মর্টন ক্লেইন দাবি করেছিলেন, ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর চাপে আল জাজিরা তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে এটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি আসলে ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলো কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে সে বিষয়ে। আল জাজিরা বলেছে, এটি মোটেই `ইহুদী বিদ্বেষী` কোন অনুষ্ঠান নয়।
আল জাজিরা আরও বলেছে, তাদের এই সিরিজের উদ্দেশ্য ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর নানা অনিয়ম ফাঁস করা এবং সত্য প্রকাশ করা যা মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হচ্ছে। আল জাজিরা বলছে, তারা স্বাধীন সাংবাদিকতার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ এজন্যে আল জাজিরা ইংলিশ যে নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যালে দ্বিতীয়বারের মতো `ব্রডকাস্টার অব দ্য ইয়ার` হয়েছে, সেটির কথা উল্লেখ করছে তারা।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমজে/
আরও পড়ুন