১৩০ বছর পর ঘরে ফেরা
প্রকাশিত : ০৪:২২, ২৭ মে ২০১৮
আহমেদ ক্রিটে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে।
আহমেদ নামের এক সিরিয়ান ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে গ্রীসে আশ্রয় পেয়েছে গত বছর ২০১৭ সালে। পেশায় পাথর ভাঙ্গার কাজ করা আহমেদ গ্রীসে প্রবেশ করেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে যান ক্রিট দ্বীপে। ৪২ বছর বয়স্ক আহমেদ এমন এক সফর শেষ করলেন যা শুরু হয়েছিল অন্তত আরও ১৩০ বছর আগে।
আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্ম হয় সিরিয়াতেই। বেড়ে ওঠেন সিরিয়ার আল হামিদিয়াহ নামক একটি গ্রামে। কিন্তু আহমেদের পূর্ব পুরুষরা ছিল গ্রীসের এই ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দা।
ক্রিটে ফিরে আসার এই সফর শুরু হয় ১৮৯০ সালে। আহমেদের বাবার বাবা অর্থ্যাত দাদার পরিবারকে ক্রিট ছাড়তে বাধ্য করা। বাধ্য করা হয় এমন আরও অনেক ক্রিটবাসীকে। তবে সেসময় অটোম্যান সাম্রাজ্য দূর্বল হয়ে পরলে ক্রিটের মুসলিম অধিবাসীদের কপালে এমন পরিণতিই নেমে আসে।
অনেক ক্রিট মুসলিমেরা পালিয়ে যান তুর্কী, লিবিয়া, লেবানন এবং ফিলিস্তিনে। আর আহমেদের দাদার মতো অনেকে যান সিরিয়ার ঐ গ্রামটিতে। সেসময়ের অটোম্যান সম্রাট সুলতান আবদুল হামিদ উদ্বাস্তুদের থাকার ব্যবস্থা করেন আল হামিদিয়াহ গ্রামটিতে।
এরপরের দুইটি প্রজন্ম কাটিয়ে দেয় এই গ্রামেই। কিন্তু মাতৃভূমিতে ফেরার তাগিদ কখনও থেমে থাকেনি। অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কেউ পেরেছেন আর কেউ কেউ পারেননি।
আধুনিক সময়ে এসে, প্রায় ১০ হাজার ক্রিট বংশোদ্ভুত মানুষজন গ্রীসের স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে সেখানকার খবরাখবর রাখতে থাকেন। এদের কেউ কেউ কাজের বাহানায় দ্বীপটিতে চলে আসতেও সক্ষম হন। তেমনি সফল আরেক ব্যক্তি আহমেদ।
ছবিঃ ক্রিটের চ্যানিয়া উপকূলের কাছে একটি মসজিদ। তবে এটি এখন প্রদর্শনী কেন্দ্র।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আহমেদ বা তার প্রজন্মের মানুষদের মাধ্যমে ক্রিটের আদি সংস্কৃতি এখনও বেঁচে আছে। এমনকি ক্রিটবাসীরা তাদের ভাষার আদি ধাঁচ অনেকখানি হারিয়ে ফেললেও উদ্বাস্তু হওয়া ক্রিটের আদিবাসীরা সেই ভাষা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আদি ক্রিটবাসোরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সবসময়ে সেই ভাষা শিখিয়ে এসেছে।
ছবিঃ ক্রিটের একটি পোস্টকার্ড যেখানে মুসলিম নারী-পুরুষদের দেখা যাচ্ছে।
আহমেদ জানান, “আমরা সিরিয়ার স্কুলে আরবি শিখতাম। তবে সবসময় বাসায় গ্রীক বলতাম। আমাদের শিশুরা গ্রীক ধাঁচে নাচ শিখত। আমরা ক্রিটের ছোট ছোট ছড়া মনে রাখতাম। এমনকি ক্রিট খাবারের আদি রেসিপিও আমরা জানি”।
শুধু তাই নয়, ক্রিটের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পুরো দুই প্রজন্ম এতটা সচেতন ছিল যে, সংস্কৃতি হারানোর ভয়ে তাদের পুরুষেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রিট নারীদেরই বিয়ে করত। আহমেদের সমাজেও শরীরে ক্রিটের রক্ত থাকা পুরুষেরা সহসা সিরিয়ান নারীদের বিয়ে করতেন না। আহমেদের স্ত্রী ইয়াসমিন নিজেও একজন ক্রিট বংশোদ্ভুত।
আহমেদ বার্তা সংস্থা বিবিসিকে আরও বলেন, “আমাদের হৃদয়ে সবসময় ক্রিটের একটা সুর বইত। আমরা সবাই জানতাম যে, আমাদের গোড়াপত্তনটা কোথায় হয়েছিল। আমাদের দাদারা আমাদেরকে ক্রিটের সৌন্দর্য বর্ণনা করে গেছেন। তারা বলতেন সেখানে নাকি দরকারি সবই পাওয়া যেতো। আমরা সবসময়ই ক্রিটে আসতে চেয়েছি তবে সুযোগ পাইনি”।
সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ হাজার হাজার মানুষ প্রাণ নিলেও আহমেদের মতো অনেক ক্রিট বংশোদ্ভুত মানুষজন তাদের আদিনিবাসে ফেরার সুযোগ পান। আল হামিদিয়াহ গ্রাম থেকে যারা ক্রিট এসে পৌছেছেন তাদের মধ্যে আহমেদের আত্মীয়স্বজনরাই প্রথম।
ছবিঃ ক্রিটে আত্মীয়দের সাথে আহমেদ।
প্রথমে আহমেদের তিন বোন আমিনা, ফাতেন এবং লতিফা তাদের নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ক্রিটে এসে পৌছান। এরপর আহমেদ ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন তাদের চার সন্তান নিয়ে ক্রিট এসে পৌছান।
ক্রিটে আসার প্রথম মুহূর্তের অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেন আহমেদ। এখানকার চানিয়া এলাকার একটি ছোট দোকানে প্রথমে প্রবেশ করেন আহমেদ। আহমেদ যখন দোকান মালিককে তার পরিচয় দিলেন তখন দোকান মালিক বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। আহমেদ জানান, “তিনি তার সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে থাকে যে, ‘দেখো! দেখো! এখানে একজন ক্রিটান এসেছেন। আসো আর দেখো”। এরপর সকলেই প্রবল উৎসাহে আহমেদ ও তার পরিবারের পাশে জড়ো হতে থাকেন বলে জানান আহমেদ।
সূত্রঃ বিবিসি
//এস এইচ এস//
আরও পড়ুন