বিবিসির বিশ্লেষণ
হিন্দুত্ববাদীদের সহিষ্ণুতার বাণী যে কারণে শোনালেন প্রণব মুখার্জী
প্রকাশিত : ০৯:২০, ৮ জুন ২০১৮ | আপডেট: ০৯:২১, ৮ জুন ২০১৮
ভারতের হিন্দু পুণরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর সদর দফতর নাগপুরে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। নিজে যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করে এসেছেন সারা জীবন, তার ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত একটি সংগঠনের সভায় যেতে তিনি কেনও রাজী হলেন আর সেখানে ভাষণে কী বলেন, তা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই বিতর্ক চলছিল।
প্রণব মুখার্জী তার ভাষণে জাতীয়তাবাদ, দেশভক্তি নিয়ে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি উল্লেখ করেছেন যে পরমত সহিষ্ণুতা প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে থেকেছে।
তিনি বলেন, সহিষ্ণুতাই আমাদের শক্তি। বহুত্ববাদকে ভারত বহু আগেই স্বীকার করেছে। ভারতের জাতীয়তাবাদ কোনও একটি ধর্ম বা জাতির জাতীয়তাবাদ নয়। আমরা সহমত হতে পারি, নাও হতে পারি। কিন্তু চিন্তার বিবিধতাকে বাধা দিতে পারি না। সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদ, বহুভাষা - এগুলোই আমাদের দেশের অন্তরাত্মা।
মুখার্জী যখন রাষ্ট্রপতি পদে আসীন, তার শেষ কয়েক বছরে ভারতের নানা জায়গায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। কখনও গরুর মাংস বাড়িতে রাখার গুজব ছড়িয়ে দিয়ে অথবা গরুর মাংস পরিবহন করা হচ্ছে এরকম সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে অনেক মুসলমানকে।
সেই সময়েও প্রণব মুখার্জী নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসাবে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধেই মুখ খুলতেন। সারা জীবন কংগ্রেস রাজনীতিতে বিশ্বাসী মুখার্জীর সেই মতাদর্শের কথা তার ভাষণে না বললে সেটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর হত। কিন্তু বৃহস্পতিবার আরএসএস প্রধান, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের ভাষণটি বরঞ্চ ছিল বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
যে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপিকে গত কয়েক বছর ধরেই সমালোচনা শুনতে হচ্ছে ধর্মীয় এবং জাতিগত অসহিষ্ণুতা ছড়ানোর অভিযোগে, সেই সংঘের প্রধানের মুখেও বারে বারে উঠে এসেছে ধর্মীয় এবং পরমত সহিষ্ণুতার কথা।
‘ভাষা বা ধর্মের বিভিন্নতা তো বহু পুরনো। রাজনৈতিক মতামতেও যে বিভিন্নতা থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। একে অন্যের নিজস্বতাকে স্বীকার করেই আগে এগোতে হবে,’ মন্তব্য মোহন ভাগবতের।
প্রণব মুখার্জীর এই আরএসএস সদর দফতরের অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে যে বিতর্ক চলছে গত ক`দিন ধরে, সেই সূত্রেই কয়েকজন বিশ্লেষক বলেছেন, প্রণব মুখার্জীর মতো একজন আজীবন কংগ্রেস নেতাকে নিজেদের মঞ্চে হাজির করে আরএসএস হয়তো এটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে যে তারা বিপরীত মতাদর্শের মানুষদের কথাও মন দিয়ে শোনে, তাদেরও নিজেদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে।
আরএসএসের অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনমোহন বৈদ্য বৃহস্পতিবার এক নিবন্ধে লিখেছেন এই গোটা বিতর্ক নিয়ে। তিনি বলেছেন, আরএসএস সবসময়েই এই বিশেষ অনুষ্ঠানে এমন ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে, যারা তাদের মতের বিরোধী বলেই পরিচিত।
সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের ভাষণ শোনার পরে বিশ্লেষকদের ধারণাটাই আরও দৃঢ় হচ্ছে, যে তাদের গায়ে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ে গিয়েছিল, সেটা হয়তো মুছে ফেলার চেষ্টা করছে আরএসএস।
২০১৯ সালে নির্বাচনের মুখোমুখি হবেন নরেন্দ্র মোদি। পর পর বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে খারাপ ফল করে তারা যে এখন কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে, এটা স্বাভাবিক। অন্যদিকে বিরোধীদলগুলো ক্রমশ একজোট হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পরমত সহিষ্ণুতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও যে ভারতেরই মানুষ, নিজেদের মানুষ - এরকম একটা বার্তাই সম্ভবত এখন দিতে চাইছে আরএসএস।
আবার অন্যদিকে প্রণব মুখার্জী কেনও এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বা সোনিয়া গান্ধী নিজে কিছু না বললেও মিসেস গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ প্যাটেল টুইট করে বলেছেন, প্রণবদার কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত।
কংগ্রেস মুখপাত্র আনন্দ শর্মা লিখেছেন, লক্ষ লক্ষ কংগ্রেস কর্মী প্রণবদার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করায় ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
শেষ পর্যায়ে বুধবার মুখার্জীর মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জী, যিনি দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র তিনিও বুধবার টুইট করে তার বাবার সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছেন।
কোনও কোনও বিশ্লেষক লিখেছেন, তিনি যে রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেননি, সেই বার্তাই হয়তো দিতে চেয়েছেন প্রণব মুখার্জী।
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনেও তাকে পাওয়া যাবে, এই বার্তাও তিনি দিতে চেয়ে থাকতে পারেন।
ভারতে এখন আলোচিত হচ্ছে যে তিনি কি তাহলে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন? এর আগে কেউ কখনও রাষ্ট্রপতি থাকার পরে প্রধানমন্ত্রী হননি, কিন্তু কেউ যে হতে পারবেন না, সেরকম কোন আইনও নেই ভারতে।
সূত্র: বিবিসি
একে//
আরও পড়ুন