মাকে তালাবন্দি করে শ্বশুরবাড়ির দাওয়াতে ছেলে-পুত্রবধূ!
প্রকাশিত : ১৩:৩২, ২২ জুন ২০১৮
খাবার বলতে এক বোতল পানি আর চারখানা বিস্কুট। দরজা-জানালা যেভাবে বন্ধ, তাতে কারও দৃষ্টি তো দূর, আলো-বাতাসও ঢুকতে পারবে না। আশি বছরের বৃদ্ধা মাকে তিন দিনের জন্য ওই অবস্থায় রেখে জামাইষষ্ঠীতে দাওয়াত খেতে বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলেন ছেলে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতার দমদমের বেদিয়াপাড়ায় এ ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার রাতে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করার পরে সব শুনে স্তম্ভিত দমদমের বেদিয়াপাড়ার বাসিন্দারা।
দক্ষিণ রবীন্দ্রনগরের ক্ষুদিরাম সরণিতে তিন কাঠা জমির উপরে নিজের বাড়ি ছিল বৃদ্ধা শোভারানি দাসের। ওই বাড়িতে প্রোমোটিং হওয়ায় ছোট ছেলে ভবনাথ দাস ও বউ শ্যামলী দাসের সঙ্গে বেদিয়াপাড়ার আর এন ঠাকুর রোডের একটি বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকেন তিনি। প্রতিবেশী এক মহিলা জানান, গত তিন দিন ধরে মাঝেমধ্যেই দরজা-জানলায় ধাক্কা মারার আওয়াজ পাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু সেই আওয়াজ যে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা করছেন, তা প্রথমে বুঝতে পারেননি কেউ। বুঝবেনই বা কী করে! অভিযোগ, বাড়িতে মায়ের অস্তিত্ব যাতে পাড়া প্রতিবেশী টের না পায়, তার জন্য বন্দোবস্তের কোনও কসুর রাখেননি ছেলে-বউ। সদর দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। শোভারানি যাতে জানালা খুলতে না পারেন, তার জন্য ভিতরের একটি জানালা ছিটকিনির পাশাপাশি চেন-তালা দিয়ে লাগানো ছিল। আর একটি জানালা কাঠের বিম দিয়ে সিল করে দিয়েছিলেন পেশায় অটোচালক ভবনাথ।
এই পরিস্থিতিতে বুধবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বৃদ্ধার কান্নার আওয়াজ শুনে বিচলিত হয়ে পড়েন প্রতিবেশীরা। চেন-তালা লাগানো জানালার পাল্লা কোনও মতে সরিয়ে ঘরের ভিতরে বৃদ্ধাকে তারা দেখতে পান। এর পর তারাই দরজার তালা ভেঙে শোভারানিকে উদ্ধার করেন। রাত ১০টার দিকে দমদম পুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে।
বৃহস্পতিবার হাসপাতালের বিছানায় বসে বৃদ্ধা বলেন, ‘যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল, ছেলেকে বললাম, চার দিন ধরে ভাত খাইনি, একটু ভাত দিয়ে যা। ভাত ছিল না। তখন বললাম একটু মুড়ি দিতে। চোখে তো দেখতে পাই না। একটু পরে বুঝলাম, মুড়িও নেই। শুধু এক বোতল পানি আর চারটে বিস্কুট দিয়ে গেছে।’ স্থানীয় বাসিন্দা শিখা রায় বললেন, ‘যাতে শৌচাগারে যেতে না হয়, তার জন্য সোম ও মঙ্গলবারের ওই অস্বাভাবিক গরমেও মাত্র এক বোতল পানি দিয়ে গিয়েছিল। নিজের মায়ের সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহারও করতে পারে!’
স্থানীয় বাসিন্দাদের রোষের মুখে ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন ভব ও তার স্ত্রী। তবে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে যুক্তি দিতে ছাড়েননি তারা। ছেলের বক্তব্য, ‘জানালা খোলা থাকলে মা মলত্যাগ করে কাগজে মুড়ে বাইরে ছোড়েন। তাই মাকে নিয়ে প্রতিবেশীরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, সেই জন্যই ওইভাবে রেখে গিয়েছিলাম।’ বৃদ্ধা মাকে দেখাশোনার জন্য লোকও তো রাখা যেত? বউয়ের জবাব, ‘আমাদের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই।’
যদিও তা মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের বক্তব্য, তিন কাঠা জমির উপরে প্রোমোটিং হচ্ছে। টাকার তো অভাব হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে শোভারানির দুই ছেলে দায়িত্বের ভার একে অপরের কোর্টে ঠেলেছেন। ছোট ছেলের যুক্তি, পাঁচতলা বাড়ি উঠলেও তারা মাকে তার ভাগের টাকা দেননি। কারণ মায়ের দায়িত্ব তো তাদেরই নিতে হবে। তার দাবি, বাড়ির প্রোমোটিং সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখছেন দাদা জগন্নাথ দাস। সেই দাদার বক্তব্য, ‘মায়ের দায়িত্ব নেবে বলেই তো ভাই তার ভাগে ১০০ বর্গফুট জায়গা বেশি পেয়েছে। আমি বাবার চিকিৎসা ও দেখাশোনার ভার নিয়েছিলাম।’ তার অভিযোগ, মায়ের খোঁজ নিতে গেলে ভবনাথের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে দিতেন না। উল্টো মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য শুরু হয়ে যেত অশান্তি।
দুই ছেলে যখন মায়ের দায়িত্ব কার বেশি, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত, তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা বলছেন, ‘আমার ছেলের কোনও দোষ নেই। ভালই যত্নআত্তি করে!’
সূত্র: আনন্দবাজার
একে//
আরও পড়ুন