ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

হোয়াটসঅ্যাপে ছেলে ধরা গুজব

ভারতে আরও চারজনকে পিটিয়ে হত্যা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৯, ১ জুলাই ২০১৮

ভারতে গত দেড়মাসে অন্তত ১৪জন মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটি হয়েছে ত্রিপুরায়, যেখানে ৪জনের মৃত্যু হয়েছে।

হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে গুজব রটানো হচ্ছে যে বাইরে থেকে ছেলেধরার দল এসেছে। ওই ভিডিওটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে সেটি পাকিস্তানের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৈরী শিক্ষামূলক প্রচার ফিল্মের অংশ।

গুজরাট থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যাসহ নানা রাজ্যে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে নিরীহ মানুষকে।

ত্রিপুরার পুলিশ বলছে, ২৭ আর ২৮ জুন সে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে ৪ জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন সুকান্ত চক্রবর্তী বলে এক যুবক, যাকে ছেলেধরার গুজব রোধ করতে গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে পাঠিয়েছিল সরকার।

একজন নারীকেও ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে। জনতার রোষে পড়ে মারা গেছেন উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরায় নানা জিনিস ফেরি করতে আসা এক ব্যক্তি। যারা আহত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন পরে হাসপাতালে মারা যান।

ত্রিপুরা পুলিশের মুখপাত্র, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল ক্ষিতিরঞ্জন দাস বলছিলেন, ‘কদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে এই ছেলেধরার গুজবটা ছড়াচ্ছিল। মানুষ সেই গুজবে বিশ্বাস করে অনেক জায়গাতেই বহিরাগতদের আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছেন। যেখানেই আমরা জানতে পেরেছি এরকম ঘটনা, সেখানেই উদ্ধার করে আনা হয়েছে। কিন্তু তারমধ্যেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরকম কয়েকটা ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। সবকটি ঘটনা একই ধরণের। কোনও বিশেষ ডিজাইন রয়েছে কী না এর পেছনে, সেটাও আমাদের তদন্তের অন্যতম দিক।’

ত্রিপুরা দক্ষিণাঞ্চলের ইন্সপেক্টর জেনারেল অরিন্দম নাথ জানাচ্ছিলেন, ঘটনাগুলোর তদন্ত যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের জেরা করে সন্দেহ করা হচ্ছে যে গাঁজা এবং ফেন্সিডিলের মতো মাদকবিরোধী অভিযান যেসব এলাকায় চালাতে শুরু করেছে পুলিশ, সেই সব এলাকাতেই ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কী-না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

তবে শুধু ত্রিপুরা নয়, এই একই গুজব গত মাস দেড়েকে ভারতের নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে।

মেসেজগুলোর বয়ান মোটামুটি একই রকম। কিন্তু একেকটি এলাকায় সেগুলোকে অনুবাদ করে দেওয়া হচ্ছে।

একটি ছোট ভিডিও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে মেসেজের সঙ্গে।

ভারতে ভুয়ো খবর বা ছবির উৎস খুঁজে বের করে, এমন একটি ওয়েব পোর্টাল, অল্ট নিউজের প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বিবিসিকে বলছিলেন ওই ভিডিওটির উৎস তারা খুঁজে পেয়েছেন।

সিনহার কথায়, ‘যে ভিডিওটি এইসব গুজব রটানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি আসলে পাকিস্তানের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৈরী একটি সচেতনতামূলক ফিল্মের অংশ। সেখান থেকে একটি ছোট ক্লিপ কেটে নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু ছবিও ছড়ানো হচ্ছে - যেগুলো নানা জায়গা থেকে যোগাড় করা হয়েছে। প্রতিটি রাজ্যে যেসব মেসেজ ছড়িয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা দেখছি যে কাছাকাছি কোনও এলাকায় ছেলেধরার ঘটনা হয়েছে, এমনটাই লেখা হচ্ছে।’

মেসেজগুলো আসল কী-না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদও কেউ অনুভব করছে না। চেনাশোনা মানুষের কাছ থেকে একাধিকবার আসছে, তাই বিশ্বাস করে ফেলছে মানুষ, বলছিলেন প্রতীক সিনহা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে কোটি কোটি মানুষ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনওরকম বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাই নেই। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে তারা অশিক্ষিতই থেকে গেছেন। তারা যা দেখছেন, তাতেই বিশ্বাস করে ফেলছেন। আর এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ওপরে নজরদারি কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, এধরণের ঘটনার তদন্তের ক্ষেত্রেও রয়েছে বহু রকমের জটিলতা।

পশ্চিমবঙ্গে সাইবার অপরাধের জন্য নিযুক্ত স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসেকিউটর বিভাস চ্যাটার্জী বলেন, ‘গুজব ছড়ানোর মতো ঘটনার জন্য শাস্তির বিধান আইনে আছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যায় এরকম ঘটনার তদন্তের ক্ষেত্রেই। এগুলো পুরোপুরি ইলেট্রনিক তথ্য-প্রমাণ নির্ভর তদন্ত। কোন ছবি বা কোন টেক্সট কে ছড়াচ্ছে, সেটা খুঁজে বার করা ফেসবুক প্রভৃতির ক্ষেত্রে সহজ। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ, যেগুলি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করে, সেগুলো অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। আবার যখন সার্ভিস প্রোভাইডারদের ওপরে তথ্যের জন্য নির্ভর করতে হয়, সেই প্রক্রিয়াটাও খুব জটিল। কারণ এইসব কোম্পানিগুলো অধিকাংশই বিদেশি, এবং তারা তদন্তকারীদের প্রাইভেসি ক্লজ দেখিয়ে সম্পূর্ণ তথ্য দিতে চায় না সবসময়ে।’

ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির একের পর এক ঘটনা এখন সামনে এলেও অতীতেও এই ঘটনা হয়েছে কলকাতাতেও।

১৯৮২ সালে কলকাতার বালিগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

১৯৯০ সালে কলকাতার কাছেই বানতলাতে ছেলেধরা সন্দেহে গণধর্ষণ করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক নারী কর্মকর্তাসহ তিনজন সরকারী স্বাস্থ্য অফিসারকে। একজন মারা যান।

সূত্র: বিবিসি

একে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি