ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

বিবিসির বিশ্লেষণ

তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধের কেন্দ্রে যে ব্যক্তি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:০৭, ১৫ আগস্ট ২০১৮

তুরস্ক উপকূলের ইযমির শহরের একটি সরু রাস্তার পাশে হলুদ ফটকের একটি চার্চ। পিয়ের ফেরিঘাট থেকে অল্প হাঁটলেই সেখানে যাওয়া যায়। শুধুমাত্র একটি বিবর্ণ সাইনবোর্ডে এই চার্চের পরিচয় বলা হয়েছে। শুধুমাত্র কয়েকজন মানুষ এই চার্চের নিয়মিত ধর্মসভায় যাতায়াত করতেন।

কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। রোববারের প্রার্থনা সভায় এখন অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদকের ভিড় লেগে যায়। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র আর তুরস্কের মধ্যে যে তিক্ত কূটনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে এই চার্চটি। কারণ এখানে কর্মরত আমেরিকান যাজক অ্যান্ড্রু ব্রনসনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার অভিযোগ এনেছে আঙ্কারা।

দুই বছর আগে পর্যন্ত অ্যান্ড্রু ব্রনসন শান্তিতেই চার্চে কাজ করতেন। তার একজন বন্ধু জানিয়েছেন, ২০১০ সাল থেকে এখানে তৈরি করা ছোট্ট ধর্মসভা পরিচালনা করতেন ব্রনসন।

উত্তর ক্যারোলিনা থেকে আসা  ব্রনসন স্ত্রী নোরিনকে নিয়ে তুরস্কে আসেন ১৯৯৩ সালে। এখানেই তারা তাদের তিন সন্তানকে বড় করেছেন। ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর এই দম্পতিকে ডেকে পাঠায় স্থানীয় থানা। তারা স্বেচ্ছাতেই সেখানে যান। কিন্তু মুক্তি দেওয়ার বদলে তাদের দুজনকেই হেফাজতে নেয় পুলিশ।

২০১৬ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর যে ৫০ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এই গ্রেফতার দিয়ে তাদের অংশ হলেন ব্রনসন দম্পতি।

কয়েকদিন পরে নোরিন ব্রনসনকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে ডিসেম্বর মাসে যাজক ব্রনসনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে তুরস্ক। সেখানে অভিযোগ আনা হয়, `তিনি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য` এবং তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কৌসুলিরা বলছেন,  ব্রনসনের সঙ্গে দুইটি গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে, যাদের সন্ত্রাসী বলে মনে করে তুরস্ক। অপরাধ প্রমাণিত হলে তার ৩৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তিনি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে) সাহায্য করছেন। এই দলের নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন- ব্যর্থ ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য যাকে দায়ী করছে তুরস্ক।

গুলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় বসবাস করেন এবং অভ্যুত্থান চেষ্টার সঙ্গে কোনও রকম জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে তুরস্কে ফেরত পাঠানোর দাবি করছে আঙ্কারা।

ব্রনসনের স্বজন এবং বন্ধুরা অভিযোগ করছেন, কূটনৈতিক দর কষাকষির হাতিয়ার হিসাবে এই ধর্মযাজককে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে তুরস্ক।

তার গ্রেফতার তাকে বরং আরো মহান করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসবাইটেরিয়ান সম্প্রদায়ের লোকজন তার জন্য প্রার্থনা করছে, এমনকি তার জন্য অনাহারেও থাকছে।

তুরস্ক জানিয়েছে, `আইন অনুযায়ী` তার বিরুদ্ধে আদালতের কার্যক্রম চলছে।

বর্তমান সংকটের শুরু হয় গত ১৮ জুলাই থেকে, যখন শুনানির পর তুরস্কের একটি আদালত  ব্রনসনকে কারাগারে রাখার আদেশ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তকে `অসম্মান` বলে বর্ণনা করেন এবং তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রতি আহবান জানান।

‘তাকে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি করে রাখা হয়েছে’ একটি টুইট বার্তায় লিখেছেন  ট্রাম্প, ‘আরটি এরদোগানের উচিত এই চমৎকার খৃস্টান স্বামী ও পিতার মুক্তির জন্য কিছু করা। তিনি অন্যায় কিছু করেননি, তার পরিবার তাকে পেতে চায়।’

স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটার কারণে গত ২৫ জুলাই  ব্রনসনকে কারাবন্দীর বদলে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এই সিদ্ধান্ততে ওয়াশিংটন স্বাগত জানালেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছে।

ব্রনসনকে মুক্তি না দেওয়ায় সর্বশেষ গত ১ অগাস্ট তুরস্কের বিচার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে হোয়াইট হাউজ।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সর্বশেষ একটি চেষ্টার পর, শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তুরস্ক থেকে আমদানি করা স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করা হবে।

ট্রাম্প টুইট করেছেন, ‘তুরস্কের সঙ্গে এই মুহূর্তে আমাদের সম্পর্ক ততটা ভালো নেই।’

গত সোমবারই মার্কিন নেতারা একটি প্রতিরক্ষা বিলে স্বাক্ষর করেছেন, যার ফলে একশোটি এফ-৩৫ ফাইটার জেট বিমান এই ন্যাটো সহযোগীর কাছে হস্তান্তর বিলম্বিত হবে।

এই বিতণ্ডা এখন পুরোমাত্রার একটি কূটনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এর আগে ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮ সালে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যখন ১৯৭৪ সালে তুরস্ক সাইপ্রাসে অভিযান চালায়।

সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞার পর তুরস্কের লিরার মূল্যমান ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা বিক্রি বাড়িয়ে দেওয়ায় আরও কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রার মানও কমেছে।

পাল্টা জবাব হিসাবে এরদোগান বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক পণ্য বর্জন করবে তুরস্ক। আমেরিকান সরবরাহকারীদের সঙ্গে ব্যবসাকারী কোম্পানিগুলোকে বিকল্প খোঁজার জন্যও তিনি আহবান জানিয়েছেন।

‘আমি আমার জাতিকে আহবান জানাচ্ছি, বিশেষ করে আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে; এখন আমাদের সবচেয়ে ভালো জবাব হবে চালকের আসনে শক্তভাবে বসা। আমরা আরও বেশি উৎপাদন করবো, আরও বেশি রফতানি করবো।’ বলেছেন  এরদোগান।

টার্কিশ এয়ারলাইন্স এবং টার্ক টেলিকমের মতো বড় ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলো ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোনও মিডিয়ায় আর বিজ্ঞাপন দেবে না।

যখন দুই ন্যাটো সহযোগী দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বৈঠকের জন্য এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে এক হাত দেখে নেওয়ার সুযোগের ব্যবহার করছেন লাভরভ। রাশিয়া এবং তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা `অবৈধ` এবং `বিশ্ব বাণিজ্যে অন্যায় সুবিধা নিতে` ওয়াশিংটন এসব করছে বলে তাদের দাবি।

তুরস্ক আর যুক্তরাষ্ট্রের এই তিক্ত কূটনৈতিক বৈরিতার কোনও সমাধানের আলো দেখা যাচ্ছে না- পাশাপাশি তুরস্কে  ব্রনসনের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

সূত্র: বিবিসি

একে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি